কয়দিন আগে আমার এক ছাত্র আমাকে কয়েকটি ইসলামিক লেকচারের ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে কিছু প্রশ্ন রেখেছিল, তার প্রশ্নগুলোর জবাব তৎক্ষনাৎ দেয়া সম্ভব হয়নি; এ লেখায় বিস্তারিত তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। ভিডিওগুলোর মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল 'রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট'; মূলতঃ এটি ছিল একটি বইয়ের রিভিউ লেকচার। দীর্ঘ সময় ধরে বেশ মনযোগ সহকারে বক্তার বক্তব্য শুনলাম, শুনতে বেশ ভালোই লাগলো; সাবলীল শব্দচয়নে বক্তা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের আয়াত দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ইসলাম বুঝাচ্ছেন। পুরো ভিডিওটি তৈরী করা হয়েছে মুলতঃ মুসলমানের ভুল-ত্রুটি এবং নানান বিভ্রান্তি তুলে ধরার জন্য। তার কথা শুনে প্রথমেই আমার যে জিনিসটি মনে হলো, তার ধারণা বা বিবেচনায় আজ পর্যন্ত (সারে চৌদ্দশ বছর) সে ছাড়া অন্য কেউই কুর'আন তেমন একটা ভালো বুঝেনি! হাদীসকে অবজ্ঞা করে যুক্তিনির্ভর কালাম শাস্ত্র দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর বাংলা ইংরেজী শব্দ চয়নে সর্বযুগের আলেম-ওলামাদের অজ্ঞতার ফিরিস্তি সে তুলে ধরেছে। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, এমন বদান্যতা দেখানোর মতো সাহস ওরা পায় কোথায় এবং কি করেই-বা পায়?
নিজের লেখা বই 'রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট' নিয়ে তার কথাগুলো আজকের দিনের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিযুক্ত; বাচনভঙ্গিতে যথেষ্ট স্মার্ট এবং শ্রুতিমধুর উচ্চারণ, আচরণে বেশ শান্ত হয়ে সে মুসলমানকে যে মেসেজটি দিতে চাইলো তা হলো এতোদিন ধরে চার মাজহাবের সবাই যা এবং যত কিছু করেছে তার সবই ছিল ভুল; এবং মুসলমান সব আজও ভুলেই নিমজ্জিত। পবিত্র কুর'আনের বিশেষ কিছু ভার্স বা আয়াত মুখস্থ করে, দেখে পড়ার মতো করে সে তার মনগড়া বক্তব্য উপস্থাপন করছে নির্দ্বিধায়; কাদীয়ানী বা খারিজিয়াতের অন্যান্য বক্তারা যেমনটা করেন ঠিক তেমনই। তার সম্বন্ধে যা বুঝতে পারলাম সে আমেরিকা প্রবাসী, প্রাশ্চাত্যে প্রবর্তিত তথাকথিত স্বঘোষিত মডারেট মুসলিম; নাম সজল রোশন।
সজল রোশন বর্তমান ফেসবুক ইউটিউবের আলোড়ন সৃষ্টিকারী একজন বক্তা; যে কি-না আহলে সুন্নাতের বা হাদিসের তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র কুর'আনের আলোকে এবাদত-আমলের প্রায়োগিক কাঠামোও বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরছেন; পাবলিক খাচ্ছেও। আরেকজনকে দেখেছি তিনি সাইন্সের মাধ্যমে পবিত্র কুর'আনুল কারীমের ব্যাখ্যা করেন; তিনি নাকি নিজেই সাইন্টিফিক কুরআনের তাফসীরকারক। এ দু'জন ছাড়াও সহজ তথ্য-প্রযুক্তির ফায়দা নিয়ে মূর্খতার এই যুগে অসংখ্য ফেসবুক ও ইউটিউবার বেরিয়েছে যারা সস্তা জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্যে ইসলামিক বিষয়কে বেছে নিয়ে যে কোন বিষয় কেন্দ্রীক একটি ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে তা তারা মিডিয়ায় বোস্ট করছে; না বুঝেই মানুষজন তা দেখছে এবং শেয়ারও করছে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই শুধুমাত্র মিষ্টি কথার ফুলঝুরিতে প্রলুব্ধ হয়ে এসব কথা শুনছে এবং অন্যকেও শোনাচ্ছে।
ধর্মীয় বিষয়ে কথা বলার একটা নীতিমালা আছে; ইচ্ছা করলেই বা মন চাইলেই ধর্মের বিষয়ে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের যে কোন বিষয়ে এতো সহজে কোন কিছু বলা যায় না বা করা যায় না। পবিত্র কুর'আনুল কারীমের শিক্ষার সারমর্ম হলো— আগে পড়ো, তারপর বুঝো, গবেষণা করো, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করো, এবং তারপরে অন্যকে বলো। কিন্তু, আমরা কি করি? ইচ্ছে মতো একটা কিছু বলে দেই; চায়ের দোকানদারও এখন মুফতি সাব সেজেছে! আর এ জন্যই আজ সজল রোশানদের মতো বক্তারা মাঠে নেমেছে, সুযোগ নিয়েছে; তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় ওরাই যেন পবিত্র কুর'আনুল কারীম প্রচারের অন্যতম ধারক ও বাহক! সজল রোশন নামের এ বক্তার খবর নিতে যেয়ে যা জানলাম তা হলো, তিনি একজন প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেইনার এবং ডিজিটাল মার্কেটিং কনসালট্যান্ট; তিনি নেমেছেন মহাগ্রন্থ কুর'আনুল কারীমের তাফসীরে! তথাকথিত সাইন্টেফিক বক্তা একজন প্রাক্তন আর্মি অফিসার; বিড়ি টানছেন আর তাফসীর করছেন, ফতোওয়া দিচ্ছেন মনগড়া!
প্রতিটি মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈমান ও আকিদা সংরক্ষণ। কিন্ত বড় পরিতাপের বিষয়, তা না করে মুসলমান আজ হয়ে গেছে কোন একটি নির্দিষ্ট মাইন্ডসেটের; দলীয় টেগ গায়ে লাগিয়ে নিচ্ছে। নিজে নিজে গায়ে সহীহ টেগ লাগালেই কোন কিছু সহীহ হয়ে যায় না, যাবে না। তাহলে দেওয়ানবাগী, তথাকথিত আহলে হাদীস এবং আরো অনেকে নিজে নিজে গায়ে সহীহ টেগ লাগিয়েছে, ওরা কি আসলেই সহীহ হতে পেরেছে? নিজ মুখে 'আহলে হক' দাবী করলেই কি আহলে হক হওয়া যায়? গায়ে টেক লাগালেই যদি সবকিছু দামী হয়ে যেতো, তবে ২৪ হাজার টাকার এডিডাস বা পুমা'র জুতাও ২৪ হাজার টাকায়ই ফুটপাতে বিক্রি হতো, ৫শ টাকায় পাওয়া যেতো না। এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা কি বলেছেন?? তিনি বলেন, "যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে; প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লাসিত।" (সুরা রুম : ৩২) সুরা মু'মিনুন-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে আরো বলেন, "কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে; প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে, তা নিয়েই আনন্দিত।'
শুধুমাত্র সার্টিফিকেট কারো জীবনেই কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি, আনে না; নিজে নিজে সহীহ বা হকের সার্টিফিকেট নিলে বা গায়ে টেগ লাগিয়ে হক বা সহীহ দাবী করলেই হক হওয়া যায় না, যাবে না; হক বা সহীহ হতে চাইলে নিজেকে শুধরাতে হবে; অন্যকে কষ্ট দেয়া যাবে না। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে হবে; দুনিয়ার কোন স্বার্থ ব্যতীত এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে নিঃশর্ত ভালবাসতে হবে; এটাই বড় ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্য মুমিনকে ভালবাসা ও একসাথে কাজ করা ঈমানের দাবী। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুমিনদের উদাহরণ দিয়েছেন 'একটি দেহের ন্যায়, একজন ব্যক্তির ন্যায় অথবা একটি দালানের ন্যায়; যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। আবার কোন কারণে শরীরের কোন অঙ্গ অসুস্থ হলে পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।' আজ মুসলিম সমাজের অবস্থা কি?
হক বা সহীহ বুঝতে হলে লেখাপড়া করতে হবে, মাথায় নিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা থাকতে হবে; রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট নিয়ে বসে থাকলে তা হবে না, হয় না। তা করতে পারলে অবশ্যই যে কারো ইমান ও আকিদা দুস্তর হয়ে যাবে; মহান রব্ব তাকে সংরক্ষণ করবেন, অবশ্যই সঠিক পথের শক্তিশালী ঈমানদার করে দেবেন। আর যার ঈমান আছে তার একটা ছোট্ট আমলও কার্যকরি হয়; অন্যথায় সবই বৃথা, সবই অসার। বর্তমান দুনিয়ায় বিধর্মীরা তথা জাপানী জার্মানীরা মিথ্যা বলে না, আমানতের খেয়ানত করে না, লোক ঠকায় না, ওয়াদার বরখেলাপ করে না, কাউকে গালি দেয় না— সকল ভালো ভালো কাজগুলো করে, ঈমান ছাড়া বাকি সব কিছুই তাদের ঠিক আছে, কিন্তু পরকালে তারা কিছু পাবে কি? কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাদেরকে দুনিয়ায় ঠিকই ঐশ্বর্য দিয়েছেন। সবকিছু থাকার পরও শুধুমাত্র ঈমান না থাকার কারণে আজকের পশ্চিমা বিশ্বের মানুষজন হতাশার অতলে তলিয়ে গেছেন। তাই আসল হলো ঈমান; কারো ঈমান পরখ করার কোন যন্ত্র হয়তো আবিষ্কার হয়নি, কিন্তু আকিদা দেখে নিশ্চিত বুঝে নেয়া যায় সে কতটা সাচ্চা মুসলমান।
যেমন— নিঃসন্দেহে ডা. জাকির নায়েক তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে অদ্বিতীয়, ডিবেটে পটু; চরমনাই পীরসাব বড় আলেম, অসংখ্য ভক্ত-মুরিদের আইডল; কিন্তু তারা আকিদার দিক দিয়ে অস্পষ্ট। আমার কাছে মনে হয় তারা খারিজিয়াতের অসংখ্য শাখার যে কোন একটির বিস্তার ঘটাচ্ছেন; ইয়াজিদের মতো একজন কাফের জাহেল ও বর্বরকেও রাদিআল্লাহু আনহু বলছেন! ওদের বক্তব্যের এপ্রোচ এবং কথাবার্তার বেশিরভাগই খারিজিয়াত সমর্থিত। আসলে তারা সৃষ্ট হন অর্থের বদৌলতে; ফেমাস তাদেরকে বানানো হয়, ইসলামকে বিতর্কিত করার জন্য; এসব ভ্রান্ত আকিদা প্রচার-প্রসার করার বদ উদ্দেশ্যে। সেই প্রাথমিক জামানায়ও ওরা ছিল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ওরা নামাজও আদায় করতো, আবার বলতো— 'রাসুল (সাঃ) আমাকে ইনসাফ করুন!' আরেকদল সাহাবী (রাঃ) নিঃসন্দেহে নবী করীম (সাঃ)-এর সকল বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, নবী (সাঃ) প্রেমে তাঁরা পাগল ছিলেন, নবী (সাঃ)-র মহব্বতে নিজেকে তাঁরা উজাড় করে দিতেন এবং নবী (সাঃ)-র কাছে তাঁরা নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন; আর এটা-ই হলো 'ঈমান'। এক কথায় বললে বলতে হয় রাসুল (সাঃ) প্রেমই ঈমান।
বর্তমানের মডারেট বক্তাদের অনেকের বক্তব্য শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে তারা নতুন করে আবার মুতাজিলা আইডোলজির প্রচার ও প্রসার ঘটাতে চাচ্ছে। ওদের নিয়ে কিছু লিখার আগে একটি বিষয় আমি পরিষ্কার করতে চাই, তা হলো— রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ঈমান, পবিত্র কুর'আনুল কারীম আমাদের জীবন বিধান; এ দুই থেকে বিন্দুমাত্র সরে যাওয়া যায় না, যাবে না। যে বা যারা তা করেছে তারা যত বড় মুজতাহিদ বা মুহাদ্দিসই হউন না কেন, ভ্রষ্টতার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছেই এবং যাবে; দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই তারা হারাবে। এক কথায় খাঁটি মুসলমানের ঈমানের রাডার হলো হুজুরপাক (সাঃ) ও তাঁর পরিবার পরিজন এবং প্রাথমিক সাহাবা (রাঃ)-গণ। এখানে এসে থেমে যেতে হবে, বিবেকের প্রশ্ন জাগানো যাবে না; কোনরূপ পণ্ডিতি এ জায়গায় করা চলবে না। ওনাদেরকে নিঃশর্ত বিশ্বাস ভক্তি ও মহব্বত করতে হবে; কারণ ওনাদের সাথে বেয়াদবি সকল এবাদত-আমলকে বৃথায় পর্যবসিত করবে।
মুসলমানদের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যা এখন সজল রোশানদের বক্তব্য শোনেন, ওদের লেখা বই পড়েন; এবং না বুঝে এক সময় এ ধরনের লোকদের অনুসারীও হয়ে যান। তাই ওদের ফ্রেন্ড-ফলোয়ারের সংখ্যা এতো অধিক। এর মূল কারণ মুসলিম দুনিয়ার বেশিরভাগ আলেম এখন নীতিভ্রষ্ট; নীতিহীনতায় উন্মত্ত লোকগুলো ব্যক্তি স্বার্থে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছে। হাতে গোনা কিছু আলেম ছাড়া বেশিরভাগ আলেম এখন তথাকথিত আচরণ করেন; ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল ওদের মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রত্যেক আলেমই এখন ব্যক্তিগত রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট নিয়ে বক্তব্য দেন; কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করেন অনেকটা নিজ মাইন্ডসেট থেকে। আর তারা মঞ্চে এখন এমনসব খিস্তিখেউড় করেন যা শুনে একজন সাধারণ বিবেক-বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষও হতবাক হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত তারা ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট করছে; এক মোল্লা আরেক মোল্লার বিরুদ্ধে মনগড়া ফতোয়া দিচ্ছে; মতের মিল না হলে অন্যকে কাফের বলছে! কেউবা নাট্যমঞ্চ বানিয়েছে ওয়াজের পবিত্র মঞ্চকে!
যা করতে চায় তাই করে বা যে ভাবেই পারা যায় সে ভাবেই নিজেকে সস্তা জনপ্রিয় করে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে; আর তা করার জন্য এমন কোন জঘন্য প্রন্থা নেই যা তারা অবলম্বন করছে না। ওরা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুনিয়ার পিছনে; সম্রাট আকবরের আমলের সেইসব দুনিয়া লোভী মোল্লা ফজল-ফৈজিদের আদর্শ বাস্তবায়নে তারা সদা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ থেকে তারা যোজন-যোজন দূরে সরে গেছে। আর এ সুযোগটাই গ্রহণ করেছে তথাকথিত নতুন সাজের মডারেট ইসলামিক স্পিকাররা। হতাশ মুসলমানও তাদের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে; রাতারাতি তারা জনপ্রিয়ও হচ্ছে। কারণ মুসলমান তো এখন আর জ্ঞানার্জন করতে আগ্রহান্বিত নন, না পড়েই তারা আধুনিক মুসলিম হতে চান বা দাড়ি-টুপি-জুব্বা পড়ে মুসলিম সাজতে চান।
তাই তো প্রজন্ম পরম্পরায় আজ প্রাশ্চাত্য ধারার মডারেট মুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; সুযোগ বুঝে নতুন এসব বক্তারা মডারেট মুসলিম হিসেবেই নিজকে উপস্থাপন করছে! আরে মিয়া, সারে চৌদ্দশ বছর আগেই তো হুজুরপাক (সাঃ) আমাদের একটি মডারেট ইসলাম দিয়ে গেছেন, নতুন করে এ টেগ লাগানোর আবার দরকার কি? এর পিছনের কারণটা কি?? মুসলমান তো শুরু থেকেই মডারেট, এখনকার মডারেট টেগ দিয়ে ওরা কি বুঝাতে চায়? Moderate শব্দের বাংলা অর্থ হলো মধ্যপন্থী; সে হিসেবে ‘মডারেট মুসলিম’-এর অর্থ ‘মধ্যপন্থী মুসলিম’। তা তো আমরা ছিলাম, আছি এবং থাকবো কিয়ামত পর্যন্ত ; তবে সংখ্যায় আসল 'মডারেট মুসলিম' খুব কমই আছে এবং পাওয়া যায়।
তথাকথিত 'মডারেট' পরিভাষাটির উদ্ভাবক পশ্চিমা বিশ্ব; আর তারা এ শব্দটি বিশেষ অর্থেই ব্যবহার করে। এর সঙ্গে মিশে আছে মূল্যবোধ ও চেতনার কিছু নিগূঢ় সম্পর্ক। আজ যারা মুসলিম বিশ্বে নিজেদেরকে ‘মডারেট মুসলিম’ হিসেবে পরিচয় দেয় বা দিচ্ছে তারা আসলে সযতনে নিজেদেরকে আলাদা করে রাখার চেষ্টা করছে, এবং সাধারণ শ্রেণির মুসলমান থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করছে! কিন্তু 'মডারেট' বা মধ্যপন্থা সম্পর্কে পবিত্র কুর'আনুল কারীমায়ই তো ইরশাদ হয়েছে, "এভাবে আমি তোমাদের একটি মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি; যাতে তোমরা মানবজাতির প্রতি সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হন।" (সুরা বাকারা : ১৪৮) তাই বলি মুসলমান তো জন্মলগ্ন থেকেই মডারেট, নতুন করে এখন আবার মডারেট টেগ লাগানোর দরকার নেই।
ইদানীং আমার ছাত্ররা প্রায়ই প্রশ্ন করে, 'স্যার, ইমাম মেহেদী (আঃ) কি জন্ম নিয়েছেন? কেয়ামত কি আসন্ন??' মানুষ যখন ডিপ্রেশনের শেষ পর্যায়ে চলে যায় তখন তাদের মনে এমনতর প্রশ্নের উদ্বেগ হয়, হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, মুসলমান সমাজ আজ এতটাই কালুষিত যার দরুন প্রত্যেকের মনেই এ ধরনের প্রশ্নের কম বেশি উদ্বেগ ঘটে। মুসলমান এখন আর কোন পথ পায় না; যার যা ইচ্ছা তাই করছে! আখেরাতের ভয় কারো মাঝে আছে বলে মোটেও মনে হয় না। যে যার মতো করে অর্থ কামাচ্ছে; কি আলেম কি জালেম! দুনিয়াদার দুনিয়া বানাবে - এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু অবাক হই তখন - যখন দেখি আলেমরা নীতি-নৈতিকতার ধার না ধেরে অনৈকতার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। পবিত্র কুর'আনুল কারীম পড়া বা মুখস্ত করা মানুষগুলো যখন অমানুষের মতো আচরণ বা কাজ করে, তখন এক শ্রেণীর অর্বাচীন তো ছলচাতুরীর আশ্রয় নেবেই; তা করে তারা মানুষকে ঠকাবে, জাহান্নামের অঙ্গার বানাবে; খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
সহজ তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে নতুন ধরনের এসব ইসলামিক বক্তারা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের আয়াতের সহজ-সরল অনুবাদ দিয়ে মুসলিম উম্মার একটি বিশেষ শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ অলরেডি করে ফেলেছে। সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণীর মুসলমানকে টার্গেট করেই তারা মাঠে নেমেছে; মানুষকে মিস গাইডও করছে। আমি দেখেছি এ দেশের বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ পাশ করা মানুষের ইসলামিক জ্ঞান খুবই সীমিত; আর মাদ্রাসায় পড়া মানুষগুলো নির্দিষ্ট 'মাইন্ডসেট' নিয়ে বসে আছে, আর তার মতের বাইরে কিছু হলেই দ্বিমত করে বা গালাগালি করে। এই সুযোগে তথাকথিত মডারেট গ্রুপ টার্গেট করেই মাঠে নেমেছে।
বেশ গভীরভাবে ওদের কিছু বক্তব্য আমি পর্যবেক্ষণ করেছি; ওদেরকে আমার কাছে 'মুতাজিলা' আইডোলজির নতুন ভার্সনের প্রচারক বলে মনে হয়েছে। দেশের আলেম-ওলামাদের বিভক্তির সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছে তারা। খারেজীয়ত, ওহাবীজম, তথাকথিত আহলে হাদীস, শিয়া, সুন্নির পরস্পর বিরোধী আচরণ এবং. বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে মুসলমান অতিষ্ঠ হয়ে 'কানা মামা' হিসেবে তাদেরকেই গ্রহণ করে নিয়েছে নিচ্ছে। কারণ, তারা পবিত্র কুর'আনুল কারীমকে বানিজ্যিক হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়াতে চাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এ দেশের কোন আলেম-ওলামাও তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে না; বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ ভেবেচিন্তে অগত্যা কলম ধরলাম।
লেখার এ পর্যায়ে এসে হযরত মুজাদ্দেদ আলফে সানী (রঃ)-কে আজ খুব বেশি মনে পড়ছে, মনে পড়ছে মুঘল সম্রাট আকবরের কথা; কেমন নাকানিচোবানিটাই না খাইয়েছিলেন মুজাদ্দেদ। আমরা প্রায় সকলেই জানি একটা সুদীর্ঘ সময় সম্রাট আকবর পাকভারতে রাজত্ব করেছেন। ধর্মীয় আবহে বেড়ে ওঠলেও কিছু ক্ষমতালোভী, ধর্মব্যবসায়ী, সার্থপর আলেম-ওলামাদের সংসর্গে পড়ে চুড়ান্ত ভাবে অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিলেন। সাধারণ মুসলমানরা এক সময় বড় বেশি হতাশ হয়ে পড়ে; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মুজাদ্দেদ আলফে সানী (রঃ)-কে পাঠিয়ে সব কিছু ঠিক করে দেন। বিষয় পর্যালোচনার খাতিরে সম্রাট আকবরের সময়কার কিছু খণ্ড ঐতিহাসিক চিত্র তুলে ধরতে হচ্ছে। আকবরের প্রাথমিক জীবনের অবস্থা এবং পরবর্তীতে তার অধঃপতনের ইতিহাস তুলে না ধরলে হয়তো পাঠক বর্তমানকে বুঝতে পারবেন না; ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়।
হিজরী ৯৬৩ থেকে ১০১৪ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছরেরও অধিক কাল দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সম্রাট আকবরের প্রথম জীবনের ঘটনাবলী থেকে জানা যায়, প্রথমে তিনি ইসলামী-আকিদা ও ইবাদতের সঠিক অনুসারীই ছিলেন। সেসময় তিনি একজন পাক্কা নামাজী ছিলেন; ঘরে বাইরে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। দ্বীনি-ইলম এবং উলামা কিরামকে তিনি খুবই তা'যিম করতেন এবং আলেমদের সহবত পছন্দ করতেন। শায়খ সেলিম চিশতী (র:)-র প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করার জন্য তিনি ফতেহপুর সিক্রীতে রাজধানী তৈরী করেন। মাঝে মাঝে তিনি পায়ে হেঁটে আজমির শরীফে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র:)-র মাযার যিয়ারতে যেতেন। জুম্মার দিন উলামাদের খাস মজলিস বসতো, দ্বীন বিষয়ে আলোচনা হতো; সম্রাট সেখানে যোগদান করতেন এবং আলিমদের খেদমত করতেন।
সম্রাটের নৈকট্য লাভ ও দুনিয়া হাসিলের উদ্দেশ্যে সেই মজলিসে কিছু 'উলামায়ে-সু' বা অসৎ আলিমদের সমাবেশ ঘটতো। যাদের পরস্পর মতানৈক্য ও বিবাদ-বিসম্বাদ বাদশাহকে পীড়িত ও মর্মাহত করে তোলে এবং তিনি আলিম সমাজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। উলামায়ে-সু'র মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিলেন মোল্লা মোবারক নাগুরী এবং তার স্বনামধন্য দুই পুত্র আবুল ফজল ও ফৈজী। শয়তান চক্রের দোসর ওইসব আলিমগণ সম্রাট আকবরের মুজতাহিদ হওয়ার জন্য একটি সনদ রচনা করে, যা ইতিহাসে 'মাহযার নামা' হিসেবে খ্যাত। এ সনদের মর্ম এরূপ— বাদশাহ আকবরের ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফের বদৌলতে আজ সারা ভারতবর্ষে শান্তি ও ঐক্য বিরাজমান। তিনি যে সমস্ত আলিম, জ্ঞানী-গুণী ও মনীষীদের একত্রিত করেছেন তারা বাস্তবিকই যাবতীয় বিষয়ে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী। তারা কুর'আন, হাদীস, দর্শন সর্ব শাস্ত্রেরই ইমাম। তারা এ মর্মে একমত হয়েছেন যে, বাদশাহ আকবরের মর্যাদা একজন মুজতাহিদের মর্যাদা অপেক্ষাও উদ্ধে............।
ডাকাতের হাতে অস্ত্র তুলে দিলে যে পরিণাম হয়, একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক আকবরের হাতে এ সনদ তুলে দেয়ার পরিণামও ঠিক তাই হয়েছিল। আকবর তখন ইজতিহাদের মাধ্যমে কুর'আন ও সুন্নাহর প্রতি জঘন্য অবমাননা প্রদর্শন করতে শুরু করে। ইমামে আজম আবু হানিফা (র:)-সহ সকল ইমামদের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা হলো; এবং এক পর্যায়ে কুর'আন হাদীসকে অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক বলে আখ্যায়িত করা হলো। এমনকি পবিত্র কুর'আনুল কারীমের ওহীকে 'বেদুইন সর্দারের মনগড়া প্রতারণা' বলে অভিহিত করা হলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়ত ও রিসালতকে 'প্রহসন' বলে আখ্যা দেয়া হলো। এভাবেই আকবর ইসতেহাদের মাধ্যমে শরিয়ত তরিকত হাকিকত মারফত সমন্বিত ইসলামি আকায়েদের ভিত্তিমূলে চরম আঘাত করলো। আকবর সাহাবীদের শানে, বিশেষ করে তিন খলীফা— হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এবং হযরত উসমান গণি (রঃ)-র খিলাফত সম্পর্কে, খন্দকের ঘটনা, সিফফিনের যুদ্ধ প্রভৃতি ঘটনা উল্লেখ করে এমন কঠোর সমালোচনা করতে লাগলো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি নামাজ, রোজা ও নবুয়াত সম্পর্কিত বিষয়ের নাম রাখেন 'তাকলীদাত'। তিনি বলেন, ধর্মের বুনিয়াদ 'নকল' বা কুর'আন হাদিসের উপর নয়, বরং 'আকল' বা মুক্ত জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত (আজকের মডারেটরাও এই মতের)।
এমন করেই 'নিরক্ষর-মুজতাহিদ' সম্রাট আকবর এক সময় নতুন ধর্ম 'দ্বীনে-ইলাহী'র নাম ঘোষণা করেন। তার পরের ইতিহাস অনেক কণ্টকাকীর্ণ। আলেমে-সু'রা সম্রাটকে পরামর্শ দিয়েছিল যে— হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর দ্বীনের সময়কাল ছিল এক হাজার বছর, তা অলরেডি পূর্ণ হয়ে গেছে। কাজেই এখন আর সম্রাটের লালিত ইচ্ছা পূরণে কোন প্রতিবন্ধকতাই রইলো না। এ পরামর্শের ভিত্তিতে আকবর তার ভ্রান্ত ধারণাকে চরিতার্থ করার কাজে পূর্ণ উদ্যমে আত্মনিয়োগ করে, এবং ইসলামি হুকুম-আহকাম বাদ দিয়ে নিজের খুশিমতো ''দ্বীনে-ইলাহী'র নতুন নতুন সব নিয়ম-কানুন জারী করতে থাকে। পরের ইতিহাস মোটামুটি আমাদের প্রায় সবারই জানা, তাই আর আগে বাড়লাম না। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা আকবরের ভ্রষ্টাচারিতা পছন্দ করেননি; রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গোলাম মুজাদ্দেদ আলফে সানী (রঃ)-কে পাঠিয়ে তিনি সব কিছু পুনরায় ঠিক করিয়ে দেন; মুজাদ্দেদ (রঃ) অনেক ত্যাগ স্বীকার করে একাই বিশাল ওই সাম্রাজ্যে আবারও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেন এবং দ্বীনের সঠিক ধারাও প্রবর্তিত করে যান।
বর্তমান জামানার আলেমরা কি তাদের থেকে খুব একটা কম কিছু? ওদেরকে শুধরাবে কে?? ওদের দ্বীনহীনতার জন্যই আজ তথাকথিত বক্তারা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের সরল বাংলা অনুবাদ দিয়ে পূর্ববর্তী পরবর্তী সকল ইসলামিক স্কলারদের মতামতকে ওপেন চ্যালেঞ্জ করার সাহস পাচ্ছে এবং ওদেকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। আমাদের এই সমাজেরই এক শ্রেনীর লোকজন আবার তাদের বক্তব্য খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে, ওদের পক্ষে সাফাইও গাচ্ছে! এর অবশ্য কিছু কারণ আছে— তারা ভদ্র এবং শান্তশিষ্টভাবে প্রতিটি কুর'আনিক বক্তব্য যুক্তির সাহায্যে মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরে। নিজেকে ইসলামের সাথে না মিলিয়েও তারা ইসলামকে নিজের ধারায় আনতে চাচ্ছে। প্রতিটা বিষয়ে তাদের কাছে যুক্তি বা লজিক প্রাধান্য পায়। তারা আগে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত ঠিক করে তারপর ওটার সাপোর্টে নিজের মতো করে যুক্তি দিয়ে ইসলামি দলিল বানায়। ইসলামী জ্ঞানের লেভেলে আসলে তারা মোটেও উত্তীর্ণ নয়, কিন্তু বেশ জ্ঞানগর্ভ কথা-বার্তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলে। ওরা নানা পর্যায়ে সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে; কোথাওবা কম কোথাও বেশী। সর্বোচ্চ ধাপের কিছু নমুনায় বলা যায়— মহিলা ইমাম জামাতে নামাজ পড়ানোর সিদ্ধতার চেষ্টা। খোদ সৌদিতেই আজ একরাতের জন্য বিয়ের পারমিশন দিয়েছে (পতিতাবৃত্তি জায়েজ করেছে)! এমন কি সমকামিতাকেও তারা বৈধ প্রমাণ করতে চাচ্ছে! আবার ওরাই নাকি মুসলিম?!
আরে বেটারা! ইসলামকে তোরা কি মনে করিস? ইসলামের কি বুঝিস?? হুজুরপাক (সাঃ)-কে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা কি শুধু দু-একটি ছোটখাটো মামুলি উদ্দেশ্য নিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন? বরং বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণের মহতী উদ্দেশ্যে মহানবী (সাঃ)-কে এই জগতে পাঠানো হয়েছে। আর তাই তো কুর'আনুল কারীমায় স্বয়ং রাব্বুল ইজ্জত ঘোষণা করেন, ‘হে নবী (সাঃ)! আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-২১ আল আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)। তোরা যে পবিত্র কালামুল্লাহ ধরিস, ছলচাতুরীমূলক ব্যাখ্যা করিস— বুক কাঁপে না? মরার বিন্দুমাত্র ভয় নেই??
পবিত্র কুর'আনুল কারীম তাফসীর বা ব্যাখ্যা করার কিছু কাইটেরিয়া বা নিয়মনীতি আছে; মিনিমাম পনেরোটি জ্ঞান না থাকলে কেউ কুর'আন তাফসীর বা ব্যাখ্যা করতে পারে না; না বুঝে করলে তওবা করে বিরত হতে হয়, অবশ্যই হওয়া উচিত। সাহাবী (রাঃ)-গণ তো একেকজন নক্ষত্র স্বরূপ, তারপরও যে কেউ মন চাইলেই তাঁরা ওয়াজ করতে পারতেন না। সাহাবী (রাঃ) আমলে ওয়াজেরীয়ানদের একটা কাইটেরিয়া ছিল; নির্দিষ্ট কিছু বিশিষ্ট সাহাবী (রাঃ) কুর'আনিক জ্ঞানে আলোকিত ছিলেন; শুধু তাঁরাই ওয়াজ-নসিহত করতে পারতেন এবং করতেন; তাবেঈন তাবে-তাবেঈন যুগেও ঠিক তেমনটাই ছিল। সিফফিনের যুদ্ধেই প্রথম বারের মতো পবিত্র কুর'আনুল কারীম ক্ষমতার জন্য অপব্যবহার করা শুরু হয়; সেই থেকে খারিজিয়াতের এই ধারা আজও বর্তমান।
যারা কথায় কথায় পবিত্র কুর'আনুল কারীমকে ব্যবহার করে, তারাই দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন কিছু নেই যা তারা করে না। বড় আশ্চর্যের ব্যাপার হলো খুবই কৌশলে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে, এমন কি নিজের মতো মনে করে! খারিজিয়াতের এই ফেতনা ইসলামের শুরু থেকেই ছিল বর্তমানেও প্রচুর আছে; দলে বরং তারাই ভারী। এই বদ আকিদার ইতর শ্রেণির প্রাণীগুলো হুজুরপাক (সাঃ)-এর পিছনেও নামাজ পড়তো, যাকাত দিত, হজ্জ করতো, রোজা রাখতো; কিনতু অন্তরের গহীনে ছিল তাদের হুজুরপাক (সাঃ) বিদ্বেষ, জেলাসি! যা একমাত্র রাব্বুল ইজ্জতই জানতেন; এবং তাই ওদের বিষয়ে অসংখ্য আয়াতও নাজিল করেছেন— সুরা তওবা ও সুরা মুনাফিকুন নাজিল হয়েছে এ সব মোনাফেকদের বিষয়ে সতর্ক করার জন্যই। খারিজিয়তের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো তাদের মাইন্ডসেট; ওরা এ থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে চায় না বা পারে না।
খারিজিয়ত আর সুন্নিয়তের মূল পার্থক্য নির্দেশক রাডারটি হলো নবী কারীম (সাঃ) প্রেম; কথা ও কাজে যা প্রকাশিত হয়। কে খারেজিয়াতের বীজের ফসল, তাকে চেনা যায় তার কথা ও কাজে; রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সাধারণ শব্দ বা বিশেষণ প্রয়োগ দেখে। আসলে হুজুরপাক (সাঃ)-কে তারা মোটেও চেনে না, চিনতে চায়নি বা পারেনি। তাদের জন্য বলছি— পবিত্র কুর'আনুল কারীমে তিন ধরনের আয়াত বিদ্যমান, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চারিত্রিক ডাইমেনশনও তিন ধরনের— বাশারিয়াত, নূরানিয়াত ও হাকিকাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)। কুর'আনুল কারীম পড়েও যারা তা বুঝতে পারে না বা জানতে পারে না তারাই অবচেতন মনে খারিজিয়াতের অংশ হয়ে যায়। কেন তাঁকে (সাঃ) দুনিয়াতে পঠিয়েছেন মা'বুদ? এ প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই নিহিত রয়েছে সিরাতুল মোস্তাকিমের পথ। হুজুরপাক (সাঃ)-কে জানা বা চেনার উৎস কিন্তু তারিখ বা ইতিহাসের কিতাব নয়, পবিত্র কুর'আনুল কারীম; হুজুরপাক (সাঃ) সম্পর্কে তাঁর (সাঃ) জীবনসঙ্গী মা আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ)-র কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'কুর'আনই তাঁর চরিত্র'।(ইমাম বুখারি, আল আদাব আল মুফরাদ, হাদিস: ৩০৮) এ থেকে কি মুসলমানের কিছু শিখার নেই??
জ্ঞানীদের মস্তিষ্কে জোনাকি পোকা ঢুকালো ও মিটমিট করে জ্বালানোর অভিপ্রায়ে পবিত্র কুর'আনুল কারীম থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত কিছু আয়াতের সরল বাংলা অনুবাদ এখানে সরাসরি তুলে ধরছি— "আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।" (সুরা সাবা : ২৮); "তিনি তাঁর রসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, অপর সমস্ত ধর্মের উপর একে জয়যুক্ত করার জন্য; আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।" (সুরা ফাতাহ : ২৮); "নিশ্চয়ই আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সত্যসহ, সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে।" (সুরা বাকারা : ১২৯); "আমি আপনাকে সুসংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি।" (সুরা বনি ইসরাঈল : ১০৫ ও সুরা ফুরকান : ৫৬); "হে নবী (সাঃ)! নিশ্চয় আমি আপনাকে সাক্ষী, শুভ সংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।" (সুরা আহযাব : ৪৫); "অবশ্যই আপনাকে আমি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।" (সুরা ফাতির : ২৪); "নিশ্চিতরূপেই আপনাকে আমি সাক্ষী, শুভ বার্তাবাহক ও সাবধানকারী হিসেবে পাঠিয়েছি।" (সুরা ফাতহ, আয়াত: ৮)।
আজ পর্যন্ত একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে কার? এ বিষয়ে কোনো জরিপ কখনো হয়েছে কি?? তা হয়ে থাকলে অবশ্যই আসমান জমিনের রহমত হযরত আহম্মদ মুস্তবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামটিই সবার উপরে থাকবে। গত দেড় হাজার বছরে দেশ-জাতি- ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে অজস্র সাহিত্যিক, সমাজনেতা, শিক্ষাবিদ, সমরবিদ, গবেষক, রাষ্ট্রনায়ক, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁকে নিয়ে বিপুল প্রশস্তি বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ না করেও তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিশ্বের ঘোর দুর্দিনে তাঁর মতো নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা অকপটে বলেছেন অনেকেই। একেবারে আটপৌরে জীবনীগ্রন্থ থেকে বিশেষায়িত গবেষণাগ্রন্থও রচিত হয়েছে অসংখ্য। একই মানুষ, একটিই জীবন, একই জীবনকাহিনী— মক্কার কুরাইশ পরিবারে জন্ম, আল-আমিন উপাধি, সিরিয়ায় বাণিজ্য, হেরা পর্বতের ধ্যানমগ্নতা, মক্কায় দাওয়াত, তায়েফের ক্ষত, মদিনায় হিজরত, বদরের যুদ্ধ, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বগমন- পুনরায় মক্কায় ফেরা, বিদায় হজ, ওফাত, রওজাতুল মদিনা- হৃদয়ের কাবা — একই কথা বহুমুখে বহুজনে বহু সাঁজে সেজেছে, তবু তা যেন অফুরান, যেন কিছু লেখা হলো আর অলিখিতই রয়ে গেল ঢের, যেন কিছু বলা হলো আর অনেক কিছুই হয়নি বলা।
ইসলাম আসলেই সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ সর্বাধুনিক একটি জীবনব্যবস্থা; তবে এ ব্যবস্থার সকল যুক্তিই স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছ থেকে আসা। একজন সাধারণ মানুষের নিজের অনেক যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু এখানে এসে তা অচল; মিলবে না, কারণ মানুষের জ্ঞান যে সীমিত। বিষয়ভিত্তিক প্রসঙ্গে আাসতে হয়, বর্তমান মুতাজিলাদের সৃষ্ট উসুলের পতাকা ধারী হচ্ছে পশ্চিমা ভাবধারার মর্ডারেট মুসলিম ও সজল রোশানের মতো কিছু ইসলামিক ফেমিনিস্ট। তারা নিজেদের যুক্তি দিয়ে নিজেদের পছন্দ মতো নিয়ম নীতি আবিস্কার করে এবং সেসব মেনে চলে মুসলিম হতে চেষ্টা করে। তাদের কাছে যদি দলিল জানতে চাওয়া হয় তবে তারা কুর'আন ও সুন্নাহ থেকেই দলিল দেয়, কিন্তু সাথে থাকে বিশাল বিশাল সব যুক্তি এবং ব্যাখাটা করে তারা নিজের মতো করে; যার সাথে ইসলামী স্কলারদের মতের কোন মিলই নেই।
গভর্নমেন্ট প্যাট্টোনাইজড এই 'মুতাজিলা'দের আইডোলজি ও আমাদের ইমামদের কিছুত অভিমত এখানে তুলে ধরছি।
মূলনীতি —
১। তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী তথা সিফতকে আল্লাহর সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে স্বীকার করে না। তারা যুক্তি দেয় আল্লাহকে কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। তাই এগুলো আল্লাহর প্রতি দেওয়া যাবে না।
২। প্রাচীন গ্রীকদের মত মুতাজিলারাও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস করে। তারা মনে করে যে আল্লাহ মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারণ করতে পারেন না। বরং মানুষ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
৩। মুতাজিলারা তাদের যুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে আল্লাহর কোন দয়া বা অনুকম্পা হবে ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন ও তাঁর প্রকৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। মুতাজিলারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার করতে বাধ্য।
৪। মুতাজিলারা মনে করে যে একজন মুসলিম যদি সর্বোচ্চ পাপ বা কবিরা গুনাহ করে তাওবা করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে, তবে ঐ ব্যক্তিকে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী-এই দুইয়ের কোনটির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। তবে চির জাহান্নামী হবে।
৫। ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ ধারণাকে মুতাজিলারা গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যে শক্তিপ্রয়োগকে তারা বৈধ মনে করে, যা মিহনা নামে নতুন এক ধারণার সাথে পরিচিত করায়।
'ইলমুল কালাম' ও 'আকল', শব্দ দুটি মুতাজিলারা খব বেশি প্রয়োগ করে; 'ইলমুল কালাম' হলো সেই পথ যা যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে, আর 'আকল' মানে হলো বুদ্ধি। মুতাজিলারা শরীয়তের দলিল ও ফাতয়া দেবার সময় তাদের বুদ্ধিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) তাঁর ছাত্রদের 'ইলমুল কালাম' থেকে দূরে থাকতে বলতেন, তিনি বলতেন—"Those who practiced it, are those retarded individuals."
ইমাম মালেক (রঃ) বলেন, "Whoever seeks the knowledge through 'Ilmul Kalaam will deviate."
ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেন, "That no knowledge of Islaam can began with the books of 'Ilmul Kalaam, as Kalaam is not knowledge. And it is better for a man to spend his whole life doing whatever Allaah has prohibited except for Shirk than to spend his life involved in Kalaam."
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেন, "No one looks into Kalaam unless there is corruption in his heart. Whoever looks into it will have his heart corrupted or his heart is already corrupted, as he has a deviant kind of inclination so he finds what is pleasurable to him in 'Ilm ul Kalaam."
তিনি ওদের সাথে বসতেও নিষেধ করে দিয়েছেন, "They should not sit with them even if they were defending the Sunnah."
আমরা বর্তমান মুসলিমরা বই পড়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি; তার ফলই ভোগ করছি। লেখাপড়া ছাড়াই কি করে অতি সহজে নেইম-ফেইম কামানো যায়, বিখ্যাত হওয়া যায় সেই দুরভিসন্ধি নিয়ে আমরা সদা ব্যস্ত। তাই, যারা কিছুটা হলেও পড়ে, তারা আমাদের খুব সহজেই হিপনোটাইজ করে ফেলে। পড়া বা জানা না থাকায় নির্দ্বিধায় তাদের যে কোন কথাই আমরা অতি সহজে বিশ্বাস করে ফেলি; যা মোটেও উচিত নয়। বর্তমান জামানার আলেমে-সু'রা যেমন করে আমাদের বোকা বানাচ্ছে, সেই একই ধরনের কাজ করছে কিছু মডারেটরাও। সাধারণ মুসলমানের জন্য ইমান রাখাই এখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে; এইসব ঠক প্রতারক আলেমে-সু ও মডারেট বক্তা থেকে আমাদের ইমান-আমল রক্ষা করতে কবে যে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা একজন মুজাদ্দেদ পাঠাবেন? আমার বিশ্বাস সেই আলোকিতজন আসার সময় হয়ে গেছে; যিনি এই ধরাকে আবার সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করবেন।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৯ অক্টোবর, ২০২২.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন