শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২

'হাই ইবনে ইয়াকজান' উপন্যাস পর্যালোচনা :


ইংরেজ সাহিত্যিক ডানিয়েল ডেফো-র উপন্যাস ‘রবিনসন ক্রুসো’ আমরা পড়িনি বা গল্পটি শুনিনি  এমন শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ এই উপন্যাসটি যে বইয়ের ছায়ায় লিখা হয়েছে তার নাম আমরা জানি না, লেখককে চিনা তো অনেক দূরের কথা; বইটির নামই-বা আমরা কয়জন শুনেছি? উপন্যাসটি আমাদের পূর্বপুরুষের লিখা, মুসলিম দার্শনিক ইবনে তোফায়েলের। যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক। দার্শনকে যিনি উপন্যাস হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন 'হাই ইবনে ইয়াকজান' নামে; স্রষ্টাকে চিনিয়েছিলেন উপন্যাস উপস্থাপনের মাধ্যমে। যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উনিশ শতকে লেখা হয়েছে 'রবিনসন ক্রুসো'; যা আমাদের মাধ্যমিক ক্লাসের পাঠ্য। অথচ যে বইটির আলোকে এ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে তার খবর আমরা রাখি না। যে বইটির প্রভাবে পুরো ইউরোপ আলোড়িত এবং আলোকিত, তার লেখককে আমরা মুসলমানরাই চিনি না জানি না। আফসোস! আমরা মুসলমানরা আমাদের পূর্বপুরুষের খবর রাখি না; খবর রাখি, অনুকরণ অনুসরণ করি প্রাশ্চাত্যের লেখকদের। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান চর্চা থেকে আমরা কতটা দূরে সরে গেছি এটা তারই প্রমাণ। যাই হউক, আজ আমি বিখ্যাত এই বইটি নিয়ে পর্যালোচনা করবো।

ইবনে তোফায়েল আন্দালুসিয়ার একজন মুসলিম মনীষী; একাধারে তিনি ছিলেন একজন লেখক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, চিকিৎসাবিদ, জ্যোতির্বিদ  এবং রাষ্ট্রের উজির। দার্শনিক এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে, তিনি প্রথম দার্শনিক উপন্যাস 'হাই ইবনে ইয়াকজান' রচনা করে সবচেয়ে বিখ্যাত হন। পাশ্চাত্য জগতে তিনি ফিলোসফিকাল অটোডিডাকটাস নামে পরিচিত। একজন চিকিৎসক হিসেবে, তিনি ব্যবচ্ছেদ ও ময়নাতদন্তের প্রাথমিক সমর্থক ছিলেন, যা তার উপন্যাসে প্রকাশ করা রয়েছে। তাঁর লিখা 'হাই ইবনে ইয়াকজান' ১৭ ও ১৮ শতকে সমগ্র ইউরোপে বেস্টসেলার বইয়ে পরিণত হয়েছিলো। আজও ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই উপন্যাসের অনুবাদ, গবেষণা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইউরোপের প্রায় সবক’টি ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। অবশ্য বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশেও উর্দু ও বাংলায় এর অনুবাদ হয়েছে এবং অনুবাদ পাওয়া যাচ্ছে। 

‘হাই ইবনে ইয়াকজান’ আজ থেকে ৯০০ বছর আগের অর্থাৎ ১২ শতকে লেখা একটি উপন্যাস। এটি বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম দর্শনভিত্তিক উপন্যাস। ১২ শতকের উপন্যাস হলেও এই বইটি ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে (১৬৫০-১৮০০) প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিলো। যেসব বই ইউরোপে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং ইউরোপকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল সেসব বইয়ের মধ্যে এই বইটি অন্যতম। শুধুমাত্র যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে কিভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় তার দার্শনিক ও কাল্পনিক এ উপাখ্যানকে সেই সময়ের দার্শনিকেরা ‘ফিলোসফাস অটোডিডাকটাস’ নামে স্বতন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। 

আমাদের অনুসন্ধিৎসু মনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে বৈচিত্র্যময় সব প্রশ্ন খেলে যায় প্রতিনিয়ত। মনস্তাত্ত্বিকভাবেই আমরা সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে ভাবতে পছন্দ করি। স্রষ্টা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার একটা প্রান্তে গিয়ে তাঁর অস্তিত্ব আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে এমন চিন্তাভাবনা ও অনুসন্ধান-প্রবণতার পেছনে আমাদের বয়স, সমাজ, রাষ্ট্র এবং অভিজ্ঞতা ইত্যাদির প্রভাবই কি শুধু দায়ী? নাকি সৃষ্টির অস্তিত্বের মাঝেই রয়েছে স্রষ্টাকে অনুসন্ধান করার মজ্জাগত স্বভাব? ঠিক এমন দ্বান্দ্বিক একটি চিত্রকে বিশ্লেষণ করে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর প্রথম দর্শনভিত্তিক উপন্যাস ‘হাই ইবনে ইয়াকজান’। এর পটভূমি হলো ভারত মহাসাগরের জনমানবহীন একটি দ্বীপ। যে দ্বীপে পশুপাখির সাথে সখ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠে একটি মানবশিশু; যার 'নাম হাই ইবনে ইয়াকজান' বা ইয়াকজান তনয় হাই। উপন্যাস পর্যালোচনায় আসা যাক—

নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছেই ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপে হাই ইবনে ইয়াকজানের বেড়ে ওঠা। সেই দ্বীপদেশে জন মানুষের কোনো চিহ্ন ছিলো না। চতুর্দিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বেষ্টনী আর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মাঝে সেই দ্বীপটিতে হাই ইবনে ইয়াকজান বড় হতে থাকেন। শিশু হাইকে প্রথমে একটি মা হরিণ দুগ্ধ পান করিয়ে লালন পালন করতে থাকে। হরিণটির কাছে মাতৃস্নেহে তিনি বড় হতে থাকেন। অন্যান্য প্রাণীদের সাথেও তার বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রাণীদের সাথে তিনি যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রাণীদেরকে তিনি বুঝতে পারতেন, আর তাকেও প্রাণীরা বুঝতো।

একদিন তিনি একটি লাঠি খুঁজে পান। লাঠির কাজ কী তা তিনি জানতেন না। পরে তিনি এই লাঠির কাজ ও নিজের দুটি হাতের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। লাঠি ও হাতের গুরুত্ব অনুধাবনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে শিকারীরূপে আবিষ্কার করেন। একদিন তার মা হরিণটি মারা যায়। মা হরিণের মৃত্যু নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনায় নিমগ্ন হন। মায়ের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে থাকেন তিনি।
এভাবে মা হরিণটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি প্রাণীর মৃত্যু সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে ধারালো প্রস্তর খন্ড দিয়ে মা হরিণটির দেহ ব্যবচ্ছেদ করতে থাকেন। দেহ ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে তিনি এই ধারণায় উপনীত হন যে, আত্মা হচ্ছে প্রাণীর সমগ্র দৈহিক অঙ্গের চালিকাশক্তি এবং এমন এক অদৃশ্য শক্তি যা মৃত্যুর পর প্রাণীদেহ ত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র। দেহ ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তিনি জীববিজ্ঞানের জ্ঞান লাভ করেন। যখন মৃত হরিণীর দেহ ক্রমশ শুকাতে থাকে তখন তিনি দাঁড়কাক থেকে এ শিক্ষাও পেলেন যে, মৃতদেহকে মাটিতে পুঁতে রাখতে হয়।

একসময় তিনি আবিষ্কার করলেন, শুকনো ডালের ঘর্ষণের ফলে মৃত গাছে আগুন জ্বলে ওঠে। তিনি এক খণ্ড আগুন নিজের বাসস্থানে এনে ঘর আলোকিত করার পন্থা আবিষ্কার করেন। আগুনের স্পর্শে তাপ অনুভবের কারণ ও এর মর্মভেদ নিয়ে ভাবতে থাকেন। এভাবে ইয়াকজান বড় হতে থাকেন এবং তার দক্ষতাও দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি প্রাণীদের চামড়া দিয়ে নিজের জুতা ও পোশাক বানাতে শেখেন। তাদের পশম ও শন ব্যবহার করতে শেখেন।

পালকযুক্ত প্রাণীর গৃহ নির্মাণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন কিভাবে গৃহ নির্মাণ করতে হয়। শিকারের জন্য তিনি শিকারী পশুকে প্রশিক্ষণ দেন। পাখির ডিম ও পশুর শিং এর ব্যবহারিক গুরুত্ব ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন। তারকা গণনাও আয়ত্ব করে ফেলেন ইয়াকজান। এভাবে বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিয়মে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন। হাই ইবনে ইয়াকজান যখন ৩০ বছর বয়সে উপনীত হন তখন একজন সাধক সেই দ্বীপে সাধনা করতে আসেন। তখন হাই ইবনে ইয়াকজান প্রথমবার নিজের মতো একজন মানুষের দেখা পান।
তার এই ৩০ বছরের জীবনের সমস্ত শিক্ষা তাকে জ্ঞানের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যে জ্ঞান সাধারণত একজন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী অর্জন করে থাকেন। তার এই জ্ঞান অর্জনের পেছনে কোনো মানুষের অবদান ছিলো না। সম্পূর্ণ জ্ঞানই ইয়াকজান প্রকৃতি থেকে শিখেছেন। প্রাণী, পরিবেশ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে তার ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ একপর্যায়ে তাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে, এই সবকিছুর পেছনে রয়েছেন একজন মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, যিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।

একটি নিষ্পাপ মনের নিজ ক্ষমতায় ক্রমান্বয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাকে বলে ফিলোসফাস অটোডিডাকটাস। গল্পের হাই ইবনে ইয়াকজানের নির্দিষ্ট ধর্ম ছিল না কোনো। সে না মুসলমান, না খ্রিস্টান, না ইহুদী। তার বর্ণ নিয়েও তার কোনো ধারণা ছিলো না। সে আমাদের মতো সমাজের বাইরের এক প্রাণীসমাজে পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, মনুষ্য সমাজ এবং কোনো ধর্মীয় গুরুর সহায়তা ছাড়া নিজে নিজেই বড় হয়েছে।

অথচ দ্বীপের প্রাণী, পরিবেশ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও পরিস্থিতিগত ঘটনাবলীর গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের এমন এক মাত্রায় উপনীত হয়েছে যা সাধারণত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীরা অর্জন করে থাকেন। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তার মধ্যে সূক্ষ্ম আন্তঃসম্পর্ক তাকে সামগ্রিক ঐক্যের বা কেন্দ্রীভূত শক্তি নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। সবকিছুর মধ্যে জড় ও আধ্যাত্মিক ব্যাপার খুঁজে পায় সে। এবং এ সবকিছুর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে একজন পরমাত্মার পবিত্র অস্তিত্ব অনুভব করে। এভাবে হাই ইবনে ইয়াকজান প্রকৃতি থেকে বিজ্ঞানে, বিজ্ঞান থেকে দর্শনে প্রবেশ করে এবং পরিণামে পরমাত্মার জ্ঞান ও মরমীবাদে নিজেকে উৎসর্গ করে তথাকথিত কোনো গুরু ছাড়াই। তাই তো বলা হয়— Nature is the best teacher. 

মুহাম্মাদ ওয়ালিউল্যাহ 
৭ অক্টোবর, ২০২২.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন