মুসলিম উম্মাহর এ কি হাল? কেনইবা তারা আজ ভীরু-কাপুরুষের দলে পরিণত হয়েছে? একদল একবিচিওয়ালা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী মোল্লার ঠুটোঁ জগন্নাথ মার্কা চিল্লাচিল্লি আর চাপাবাজী দেখে বিবেকবান মানুষ মাত্রই লজ্জায় মুখ লুকায়। বুদ্ধিদীপ্ত কোন কাজেই আজ আর মুসলমান সন্তানদের সন্তোষজনক কোন অগ্রগতি নেই, নেই কোন কৃতিত্ব; কারণ তো সেই একই, গবেষণাহীন শিক্ষা। তাই তো মুসলিম আজ শতধা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে! আমি মনে করি এসবের মূলে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজ করছে তা হলো মুসলমানের জামাতে কাতারের বিচ্ছিন্নতা ও এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর উদাসীনতা। একটু লক্ষ্য করলেই আবিষ্কার করা যায়, হেরেম শরীফের নামাজের কাতারে যেমন কোন শ্রী নেই, (ধনী-গরিব চিহ্নিত কাতার ও অজ্ঞের ইচ্ছেমতো কাতারবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা), শহর বা গ্রামের মসজিদে নামাজের কাতারেও সেই একই ত্রাহি অবস্থা!
ইহুদি চক্রান্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনাকালীন ফতোয়া — নামাজের কাতারে তিনফিট দূরে দাঁড়ানো এবং এর অনুশীলন প্রাকটিস বর্তমানেও বহাল তবীয়তে মসজিদে মসজিদে বলবত আছে বলেই মনে হচ্ছে! প্রায় প্রতি ওয়াক্তেই কারো না কারো তীর্যক কটাক্ষ বা কপাট দৃষ্টির মুখামুখি হতে হচ্ছে আমাকে; সামনের কাতারে ফাঁক দেখে ডুকতেই বা নিজের পাশের ফাঁকে দাঁড়ানোর জন্য পিছন থেকে অন্যকে ডাকতে গেলেও তীর্যক চোখ দেখতে হয় পাশের জনের; আফসোস! বাজারে গিজগিজ অবস্থায় অন্যের ঘামের গন্ধ নিতে কোন সমস্যা নেই, অথচ যত সমস্যা মসজিদে, নামাজের কাতারে! জামাতের কাতারের এই হালের জন্যই আজ মুসলিমের পরস্পর বিশ্বাস-ভ্রাতৃত্ব উবে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। গোড়ায় গলদ রেখে আগায় পানি দিয়ে কি লাভ? জান্নাতের প্রশান্তি প্রত্যাশা সে তো অলীক চিন্তা! আমাদের উপর থেকে আল্লাহর রহমত যে উঠে গেছে বা যাচ্ছে তা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? একবার কি ভেবে দেখেছি মুসলিম সমাজে পরস্পরের মধ্যে আজ এতো অবিশ্বাস এতো মতভেদ আর এত্তো মতানৈক্য কেন??
কোন সন্দেহ নেই মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পাচ্ছে, কিন্তু সৌহার্দ্য-শিষ্টাচারের কি অবস্থা? কাবা'য় তাওয়াফকারীর আজ অভাব নেই, মসজিদে মসজিদে মুসুল্লির কমতি নেই, কমতি মুসলমানের শিক্ষায়; বিশ্বাস-ভক্তি ও শিষ্টাচারে। ইসলামের অন্যতম রোকন হলো সালাত, যা ইসলাম ও কুফ্রের মধ্যে পার্থক্য বিধান করে, আর এই বিধানের অন্যতম দিক হলো জামাতবদ্ধ হয়ে সালাত। ইসলামী জীবন বিধানের প্রতিটি বিধি-বিধানেই নিহিত রয়েছে অসংখ্য হিকমত; আমরা বেশিরভাগ মুসলমান হয়তো আজকাল এসবের তোয়াক্কাও করি না। স্বল্প ও সীমিত জ্ঞান দ্বারা আমরা অনেকেই বুঝতে সক্ষম নই বা জেনে বুঝেও পালন করি না বা বাস্তবায়নে উদাসীনতা অবলম্বন করি; সব কিছুতেই গড্ডালিকাপ্রবাহে গাঁ ভাসিয়ে চলতে চাই। জীবনের সর্বাবস্থায় ইসলামকে ধারণ ও পালন কারার মাঝেই যে নিহিত রয়েছে সত্যিকার শান্তি স্বস্থি ও প্রগতি, ইহকাল ও পরকালের মুক্তি ও কল্যাণ, তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না; অবশ্য অনেকেই মুখে বলি কিন্তু নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে মোটেও চেষ্টা করি না।
প্রত্যেক মুসলমান পুরুষের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত জাম‘আতের সাথে আদায় করার বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এই বিধানটির মূলে রয়েছে অসংখ্য হিকমত; পারস্পরিক ভেদাভেদ, অনৈক্য ও হিংসা-বিদ্ধেষ দূর করার এবং মানুষের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, ভালোবাসা, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির এক অনন্য প্রশিক্ষণ, তেমনি এটি হলো মুসলমানের ঐক্যের প্রতীক। সাদা-কালো, ধনী-গরীব, বাদশাহ-ফকির, আশরাফ-আত্বরাফ বা জাত-বংশের কোন তারতম্য ও ভেদাভেদ নেই একমাত্র ইসলামে; এবং নামাজের কাতার হলো এই অনুশীলনের অনন্য জায়গা। আমরা সকলেই আল্লাহ্র বান্দাহ এবং পরস্পর ভাই ভাই, আল্লাহ্র পথে আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ— গোঁটা বিশ্বকে এই নিরব বার্তা পৌঁছে দেয়ার এবং এর বাস্তব চিত্র প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম হলো পাঁচ ওয়াক্ত জাম‘আতে সালাত। আর এই জাম'আতে সালাতের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম একটি বিষয় হলো সফ বা কাতার ঠিক করা।
নু‘মান ইবনে বশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত, সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুসলিম শরীফের একটি হাদীস; তিনি বলেন— রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সালাতে আমাদের কাতারগুলো এমনভাবে সোজা করাতেন যেন তিনি এর দ্বারা কামানের কাঠ সোজা করছেন, যতক্ষণ না তিনি উপলব্ধি করতেন যে, আমরা তাঁর থেকে বিষয়টি পুরোপুরি বুঝে গেছি। অতঃপর একদিন তিনি বেরিয়ে এসে সালাতে দাঁড়িয়ে তাকবীর দিতে যাবেন (তাকবীরে তাহ্রীমাহ বলে নামায শুরু করতে যাবেন) এমন সময় দেখলেন যে, এক ব্যক্তির বক্ষ কাতার থেকে এগিয়ে আছে; তখন তিনি বললেন, 'হে আল্লাহ্র বান্দাগণ! অবশ্যই তোমরা তোমাদের কাতারগুলো সোজা-সঠিক করে নেবে, অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের চেহারায় (পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারার মধ্যে) বিভেদ-মতানৈক্য সৃষ্টি করে দেবেন।'
মুসনাদে আহমদ, সুনানে আবু দাউদ ও সুনানে নাসায়ীতে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন— রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, "তোমরা নামাজে কাতারগুলো সোজা-সঠিক করো, পরস্পরের কাঁধ সমান্তরাল রেখো, ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করো, তোমাদের ভাইদের জন্য হাত নরম করো (কেউ যদি কাতারে প্রবেশ করতে চায় তাহলে হাত শক্ত করে রেখোনা যাতে সে ঢুকতে না পারে, বরং হাত নরম করে তাকে কাতারের ফাঁকে প্রবেশের সুযোগ দাও) এবং শয়তানের জন্য ছোট ছোট ফাঁকা জায়গা ছেড়ে দিও না। যে ব্যক্তি (নামাজে) কাতার মিলিয়ে রাখে (কাতারের ফাঁকা জায়গায় প্রবেশ করে ফাঁক বন্ধ করে কাতার মিলিয়ে রাখে) আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাকে তাঁর (রহমতের) সাথে মিলিয়ে রাখেন, আর যে ব্যক্তি কাতার বিচ্ছিন্ন করে (কাতারের মধ্যে ফাঁকা জায়গা রেখে দেয়, যদ্দরুন দু’জন মুসাল্লী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তদ্বারা কাতারও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়) আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাকে তাঁর (রহমত) থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন।"
আমাদের দেশের প্রায় মাছজিদেই সম্মানিত ইমাম সাহেবরা খুব বেশি হলে বলেন, 'কাতার সোজা করুন, মোবাইল ফোন বন্ধ করুন', অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের কাতার সোজা করতে সময় নিতেন এবং বেলাল (রাঃ)-র হাতে লাঠি দিয়ে কাতার সোজা করতে পাঠাতেন। আর বর্তমান ইমাম সাবরা গোলামী করছেন যেন সমাজের! ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে তারা হুজরায় আসেন, তাকবীর দেন; কাতার ঠিক হোক বা না হোক এ দিকে তাদের কোন দৃষ্টি নেই; অন্যের তো আর কোন দায়ই থাকলো না! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মসজিদের নির্দিষ্ট সময়ে কেবল নামায শুরু করে দেয়াটাই যেন তাদের উপর ওয়াজিব; জুমু‘আর সালাত এবং ঈদের সালাতের কাতারের তো আরো করুণ অবস্থা। ইমাম সাব দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রথমে বাংলা খুৎবা দিতে থাকেন, অন্যদিকে জুমু‘আ পূর্ববর্তী সুন্নত নামাজের জন্য এতই সংক্ষিপ্ত সময় দেয়া হয় যে, ধীরে-স্থিরে চার রাকাত সালাত আদায় করাও খুবই কঠিন হয়ে পড়ে; ইতোমধ্যে আবার ইমাম সাব আরবী খুতবা দিতে শুরু করে দেন। ঈদের সালাতেও যেখানে খুতবা সালাতের পরে দেয়া ওয়াজিব, সেখানে দেখা যায় যে, ইমাম সাব সালাতের আগেই বাংলায় খুতবা (ভাষণ) দিতে থাকেন, সালাত শুরু হওয়ার এক মিনিট পূর্ব পর্যন্ত তার ভাষণ চলতে থাকে, এবং হঠাৎ করেই 'নামায শুরু হচ্ছে, কাতার সোজা করুন' বলে মানুষের বিরাট দল কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকবীর বলে নামায শুরু করে দেন! এদিকে দেখা যায় কাতার সোজা হওয়া তো দূরের কথা অসংখ্য মুসুল্লি কাতারের বাইরেই এলোমেলোভাবে যে যেভাবে পারছেন নামাজে অংশগ্রহণের চেষ্টা করছেন; অনেকের হয়তো দু’তিনটি তাকবীরই বাদ পড়ে যায়। ওদিকে ইমাম সাব যথাসময়ে সালাত শুরু করতে পেরে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন!
সাধারণ মুকতাদী কিংবা মাসজিদ পরিচালনা কমিটির কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু ইমাম সাহেবরা কি জানেন না জাম'আতের অর্থ ও তাৎপর্য? সফ বা কাতার সোজা করার অর্থ ও গুরুত্ব?:জাম'আতে সালাত আদায় করার পিছনে কি হিকমাত বা প্রজ্ঞা নিহিত? জাম'আতে সালাত আদায়কালীন তাদের কি করণীয়? হাদীসে এসময় কী করার নির্দেশ রয়েছে তারা কি তা জানেন না? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমাগণ তখন কি করতেন? তারা কি নির্দিষ্ট সময় হলেই 'আল্লাহু আকবার' বলে নামাজ শুরু করে দিতেন, নাকি সর্বাগ্রে তাঁরা সফ বা কাতার সোজা করতেন? যদি এসব মৌলিক বিষয় কারো জানা না থাকে, কিংবা জানা থাকলেও তা পালন ও বাস্তবায়নের মত সৎসাহস না দেখায় তবে তার ইমাম হওয়ার দরকার কি? লা'নত এমনসব ইমামদের উপর। আর নির্দ্ধিধায় বলা উচিত এমন গর্দভ কোনভাবেই ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
বহু গবেষণার ফল, অজ্ঞতার কারণে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মুকতাদী আজ উপরোক্ত বিষয়ে চরম উদাসীন। প্রায় প্রতিটি মসজিদে জাম'আতকালীন কাতারের (সফ বা লাইনের) অবস্থা দেখলে সহজেই বুঝা যায় যে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক হৃদ্যতা, আন্তরিকতা ও ঐক্যের বড় অভাব; বিশৃঙ্খল অবস্থা। অনেকের কাতারে দাঁড়ানোর অবস্থা দেখলে বুঝার কোন উপায়ই থাকে না তারা কি নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছেন না কি অন্য কোন কাজের জন্য? পায়ের অবস্থান- সে তো এক পা আগে, আরেক পা পিছনে; যেখানে নামাজে দাঁড়ানো কিংবা বসা সর্বাবস্থায় উভয় পায়ের অগ্রভাগ ক্বিবলামুখী থাকা আবশ্যক, সেখানে দেখা যায় যে, অধিকাংশেরই ডান পা উত্তরমুখী আর বাম পা দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে। এই যদি হয় প্রত্যেক মুকতাদীর দাঁড়ানোর অবস্থা, তাহলে সমবেত নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় সফ বা লাইনের চিত্র কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
প্রত্যেক মুকতাদীর অবশ্যই জানা উচিত, জাম‘আতে সালাত আদায়কালীন পরস্পর কাঁধ সমান্তরাল রেখে এবং একে অপরের পায়ের গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলিয়ে মধ্যবর্তী ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে সোজা-সঠিকভাবে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; আর এটাই মূলত মুকতাদীর কাজ। ইমাম সাহেবের দায়িত্ব হলো- বিষয়টি নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে কঠোরতা আরোপ করা এবং কাতার সোজা ও পুরোপুরি ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত সালাত শুরু না করা। শুধু তাই নয় বরং সালাত শুরুর পূর্বে, জুমু‘আর খুতবায় কিংবা ধর্মীয় বিভিন্ন আলোচনা সভায় এতদ্বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে কোর'আন ও সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ দালীল-প্রমাণসহ সাধারণ মুসলমানকে অবহিত করা। কিন্তু হায়! বর্তমান মুসলিম সমাজের তথাকথিত আলেম-ওয়ালামা ওয়াজেরীয়ানদের একি হাল? ইমাম সাবদেরই-বা এ কি অবস্থা?? নামাজের কাতারেরই-বা কি হাল??? আফসোস!!
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৩০ এপ্রিল, ২০২২.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন