রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

এবারের ঈদ ও কিছু এলোমেলো ভাবনা:


রোজার ঈদের বাংলা একাডেমির ভেল্কি ছিল বাংলা অভিধানে শব্দ পরিবর্তন  'ঈদ' মুছে 'ইদ' সংযোজন; শেষ পর্যন্ত আমরা তা রুখে দিয়েছি। এদেশের বেশির ভাগ মানুষ ঈদেই থাকতে চেয়েছি, থেকেও গেছি; কারণটি তো অত্যন্ত স্পষ্ট, ইদ আমাদের মোটেও প্রাণ জুড়াতে পারে নি, মনকে শান্ত তৃপ্ত করতে পারে নি। কিছু কিছু শব্দ কিছু কিছু অভিব্যক্তি বাঙালীর রক্তের সাথে এমন ওতপ্রোত ভাবে মিশে গেছে, যা কোন ভাষা পণ্ডিতের বা কারোর প্রচেষ্টায় হুট করেই পরিবর্তন হওয়ার মতো নয়। কেউ পারবেও না হয়তো বাঙালীর সহজাত স্বভাবগত মূল বিষয় বিশ্বাসে চির ধরাতে। ঈদ তেমনই একটি উৎসব যা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম; প্রতিটি বাঙ্গালির জীবনে ঈদের আনন্দ উচ্ছাস সম্পূর্ণই আলাদা অন্য রকম এক অনুভূতি।

এবারের কোরবানি ঈদ এলো আমাদের সামনে অনেকগুলো কষ্ট নিয়ে; একদিকে চোখের সামনে বানবাসী মানুষের অসহায় রুগ্ন ব্যথিত মুখ, পাশবর্তী রাষ্ট্র মায়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দ্বারা মুসলিম গনহত্যায় কয়েক লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর হৃদয় বিদারক কান্না ও হাহাকার সর্বস্ব জীবন। অপরদিকে ঢাকা ময়মনসিংহের ব্যস্ততম মহাসড়কে চলমান বাসে ঘটল দেশের সবচেয়ে নেক্কারজনক ও জাতির জন্য লজ্জাষ্কর দুঃখজনক ঘটনাটি ঈদের ঠিক কয়েক দিন আগে - চলন্ত বাসে  কিছু নরপশু রূপা নামের প্রাণঞ্চল কর্মদ্বীপ্ত উচ্ছল একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর মুখ থেতলে ঘাড় মটকে মেরে বাস থেকে রাস্তার পাশে ফেলে দিলো; সেই রূপা'র অপূর্ণ অতৃপ্ত আত্মার অভিশম্পাত নিয়ে শুরু হলো আমাদের এবারের ঈদ যাত্রা। 

এত কিছুর পরও ঈদ এসেছিল, ঈদ আসে ঈদ আসবে, ঈদ চলেও যায় এবং যাবেও। যত কিছুই হউক যত কিছুই ঘটুক; হউক তা শব্দে বা বাক্যে বা মহা দুঃখ মহা কষ্ট নিয়ে আসুক কারো জীবনে, তারপরও এসবের মাঝেই এদেশের মানুষ ঈদ আনন্দ উপভোগ করবেই এবং প্রতিটি ঈদে নাড়ীর টানে আপনজন পরিবারের সংস্পর্শে গিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার অন্যরকম এক উদ্যম সঞ্চিত করে নিয়ে আসবেই। মোবাইল যেমন করে বিদ্যুতের সংস্পর্শে কিছুক্ষণ রাখার পর চার্জ পায়, ঠিক তদ্রুপ সারা বছর প্রিয়জন থেকে বহু দূরে থেকেও ঈদের ছুটির এই কয় দিনেই ভালোবাসার মানুষদের সান্নিধ্যে অনেকটা সারা বছরের চার্জ নিয়ে পুনঃ উদ্যোমে আবারও আমরা শুরু করবো দেশকে গড়ার কাজ, এগিয়ে নিয়ে যাবো আমাদের যার যার কর্মযজ্ঞ দিয়ে।

অনেক বছর পর এবার সপরিবারে আমিও ঈদ করতে এলাম আমার প্রিয় জন্মস্থান জন্মভূমি ও বেড়ে উঠা সেই গ্রামে। ভাই বোন ও তাদের সবার ছেলেমেয়েসহ আমারা এবার গ্রামে বৃদ্ধা মা'কে নিয়ে একসাথে ঈদ করলাম; তাই এবারের ঈদের মজাটাই আমাদের কাছে আলাদা, সম্পূর্ণ অন্য রকম। আজ যদিও-বা এখানে শহুরে ছোঁয়া লেগেছে, আমাদের সেই চীর চেনা গ্রামের পরতে পরতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, তাও বেশ ভালোই লাগছে। চারদিকে এখনো এখানে আছে সবুজের এক অপূর্ব সমাহার, জলাশয়; নতুন করে নতুন আঙ্গিকে পাশাপাশি গড়ে উঠছে পরিকল্পিত রাস্তাঘাট বাড়িঘর সব কিছু।

এক সময় ঢাকার এতো কাছের আমাদের এই এলাকাটিও ছিল খুবই অবহেলিত, সম্পূর্ণ একটি অজপাড়া গাঁ। মহানগরের এতো সন্নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা থেকে বাড়ি পৌঁছতে আমাদের প্রায় সারা দিন চলে যেতো; কমলাপুর থেকে ট্রেনে চড়ে আড়িখোলা স্টেশনে নেমে সেখান থেকে রিক্সায় এবং পায়ে হেঁটে অথবা ডেমরা থেকে লঞ্চে দেবই নেমে পায়ে হেঁটে অথবা বর্ষায় রামপুরা ব্রীজের পাশ থেকে নৌকা করে হরদী নাওটানা খাল বেয়ে বাড়ি পৌঁছতে হতো। 

যন্ত্রনাদায়ক সেইসব ভ্রমনের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে বললে, তাদের কাছে মনে হবে এসব শুধুই অলীক বানানো গল্প! আমার বিয়ের পরে প্রথম বছর ঈদে কমলাপুর থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ট্রেনে উঠি, সাথে ছিল বিরাট এক লাগেজ, যা মাথার উপর কেরিয়ারে রেখেছিলাম। ট্রেন আড়িখোলা থামতেই ঝটপট ষ্টেশনে নেমে দেখি লাগেজ পুরোটাই খালি! বিয়ের স্মৃতিমাখা সব কাপড়চোপড় ও মা-বাবা সহ ছোটছোট ভাইবোন আমাদেরও সবার সেবারের ঈদের সব আনন্দ ছিল সেই লাগেজে। আমাদের ঈদটাই সে বছর মাটি হয়ে গিয়েছিল।

সেই অজপাড়া গাঁ এখন আজকের নিউ টাউন পূর্বাচল। বাড়ির নাম্বার রোড নাম্বার হোল্ডিং নাম্বার সেক্টর নাম্বার সবই নতুন করে বাড়িতে লেগেছে; ঈদের আগের দিন বাড়ি পৌঁছে আমার কাছে মনে হলো, এখনো এলাকাটি আমার সেই চীর চেনা গ্রামই রয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এতোটাই উন্নতি ঘটেছে যে, তিনশ ফিট ধরে ঢাকা থেকে বাড়ি পৌঁছা এখন মাত্র মিনিট ত্রিশের ব্যাপার। দুটো ফ্রাই ওভার পেরিয় মাত্র বারো/তেরো কিলোমিটার পথ পেরোতেই আমাদের গ্রাম, বাড়ি। পথে কোথাও জ্যাম নেই, নেই কোন আঁকাবাঁকা। 
তারপরও আজকাল কেন যেন গ্রামে আসা আমার খুব কমই হয়। কারণ, গ্রামে স্থায়ী বসবাস করা লোকগুলোকে মাঝেমধ্যে আমার খুবই অচেনা মনে হয়। ছোট থেকেই গ্রাম্য পলিটিক্সকে আমি এড়িয়ে চলতাম, খুবই নোঙরা মনে হতো; এখন তো এইসব আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আগের সেই  আঁকাবাঁকা পথগুলো, ক্ষেতের সেই বাঁকগুলো যেন এখন গ্রামে থাকা মানুষের চরিত্রের সাথে মিশে গেছে! 

আজকের গ্রাম আর সেই আগের মতো  নেই, নগরায়নের ছোঁয়া গ্রামের পরতে পরতে লেগেছে। রাস্তঘাট পথ প্রান্তর সহ গ্রামের ঘরগুলোও পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। মাটির ঘরের জায়গায় গড়ে উঠছে ইটের দালান, গ্রামের মাটির মসজিদটি ইটের দালান হয়েছে, এখানেও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মেশিন লাগানো হয়েছে। অনেকের বাড়ির সামনে প্রাইভেট কার, মটর সাইকেলও শোভা পাচ্ছে। মানুষের চেহারা দেখেও বুঝা যায় তাদের ভাগ্যের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এসব পরিবর্তন চোখে পরলো গ্রামের পথে পথে; গ্রামে ডুকেই জানতে পারলাম ভোলার স্ব-নামধন্য এক মন্ত্রীর মেয়ে-জামাই আমাদের গ্রামে জায়গা কিনে ডাকবাংলা হাঁকিয়েছেন; প্রতি শুক্রবার তাঁরাও নাকি সারা দিন এখানে সময় কাটান। 

এখনো আমাদের এলাকার বাড়িঘরগুলো একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে দূরে। দেশের বেশ পুরনো একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য আমরা; শতাব্দী ধরে বাড়ির বেশ প্রতাপ প্রতিপত্তিও আছে; এক নামেই বহু দূর থেকেও মানুষজন আমাদের নামেই চেনে। আগে সবাই আমরা এক বাড়িতেই তিন ভিটায় বসবাস করতাম; সেই স্থানটি এখন আমাদের কাছে স্মৃতিময় পুরোন বাড়ি। ঐ বাড়িতেই আমার জন্ম। অবশ্য আমাদের আগের প্রজন্মই বিশাল জয়গা সমেত পাশের গ্রামে এসে প্রত্যেকেই বসতি গড়েছেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বড়রা ঢাকায় চাকুরী করলেও প্রতিটি পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বাড়িতেই স্থায়ী বসবাস করতাম; তাই সব সময় লোকজনে পুরো বাড়ি ঘমঘম করতো। কালের পরিবর্তনে উন্নত শিক্ষা ও উন্নত নাগরিক সুবিধার তাগিদে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই শহরে স্থায়ী নিবাস গড়তে শুরু করে। তাই সেই বিখ্যাত বাড়িটিরও আগের সেই জৌলুস অনেকটা হারিয়ে গেছে। 

বাড়ির দু এক জন মুরুব্বী যদিও এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরাও সন্তানের সাথে এখন স্থায়ীভাবে ঢাকায়ই বসবাস করেন। তাছাড়া বাড়ির বেশিরভাগ ময়মুরুব্বী এখন আর বেঁচে নেই, ভাইব্রাদার অনেকেও চলে গেছেন না ফেরার দেশে, তাই আগের মতো সেই প্রাণ চাঞ্চল্য ও প্রাণের স্পন্দন বাড়িতে এখন আর নেই। তাই কারোরই বাড়ি আসার তেমন নাড়ির টান আত্মার তাগিদও নেই। যেমন - আমাদের বাবা বেঁচে থাকতে অন্য সময় বাড়িতে আসি বা না আসি, প্রতি ঈদে ছুটিতে অবশ্যই হৃদয়ের উচছাস নিয়ে আগে আগে বাড়িতে ছুটে আসতাম। বাবার মৃত্যুর পরও অবশ্য বেশ কয়েক বছর নিয়মিত এসেছি, কিন্তু ছেলে মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে আস্তে আস্তে জীবনটা কেমন যেন অন্য রকম হতে শুরু করলো; ফেরা আর তেমন একটা হয়ে উঠে না।

প্রজন্ম পরিক্রমায় আমার দেখা তিন পুরুষের মধ্যে আমাদের পূর্বপূরুষরা যথেষ্ট কায়িক পরিশ্রমী ছিলেন; তাঁরা যেমন ক্ষেতেও কাজ করতে পারতেন, অফিসেও সফল ছিলেন। মাইলের পর মাইল তাঁরা পায়ে হেটে বেড়াতেন, পুকুরে গা হাত মুখ ধুইতেন, পরিশ্রান্ত হলে গাছ তলায় মুক্ত বাতাসে বিশ্রাম নিতেন; আমরাও এসব দেখে এসব করেই প্রকৃতির সাথে মিশে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়েই বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি। তাই আমাদের রোক-শোক-যন্ত্রনাও অনেকটা কম। আজকের আমাদের হাইবীড প্রজন্ম অনেকটাই ডিজিটার সেল্ফি প্রজন্মে পরিনত হয়েছে; কায়িক পরিশ্রম তারা মোটেও করতে চায় না, কিছুটা হাটাহাটি করতেই ক্লান্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বৈদ্যতিক পাখা চালিয়ে স্মার্টফোন বা টিভির দিকে মুখ করে বসে থাকে। প্রকৃতির সাথে মেশার, দৃষ্টি দেয়ার বা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয়ার মোটেও কোন ইচ্ছা তাদের জাগে বলে মনে হয় না।

আজকালকার ছেলে-মেয়েরা প্রকৃতির  প্রয়োজনীয়তার কথা মোটেও আসলে চিন্তা করে না; তাই স্মার্টফোন, সেল্ফি আর ফেসবুক নিয়েই তারা এখন ব্যস্ত থাকতে, সময় কাটাতে পছন্দ করে। কয়েকটা ছবির জন্য গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য তারা লোকেশনাল আউটফিট হিসেবে বাছাই করে, অতপর ক্লিক ও আপলোড টু ফেসবুক! গ্রাম তারা মোটেও পছন্দ করে না, গ্রামে থাকতে অভ্যস্তও নয় তারা, তাই দু'দিনের বেশি থাকতেও চায় না। দুই রাত থাকলেই ঢাকায় ছুটে যেতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। এসবের জন্য অবশ্য আমরাই দায়ী। ওদেরকে প্রকৃতি ও গ্রাম প্রেমী করে আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। ১০০০/১২০০ বঃফিটের ছোট্ট ঘরে হাইব্রীড মুরগীর মতো ফিড মুখে তুলে তাদেরকে আমরা বড় করেছি! বুঝতে দেইনি জীবনের আঁকাবাঁকা কত কি গতি।

 এক সময় এই গ্রামই ছিল আমাদের সবার শিকড়, প্রাণের স্পন্দন। কোন জাতি যদি শিকড়কে অস্বীকার করে, অবহেলা করে, সে জাতি যতই উন্নত হউক, কখনো শান্তির অগ্রদূত হতে পারে না, পারবে না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় শহরের বসবাস করা লোকজনের চেয়েও গ্রামের একজন কৃষক অনেক বেশি সরকারের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে; ইউরোপে ফসল ফলানো একজন কৃষক যেসব কার ব্যবহার করে নগরের অনেকে তাতে চড়ারও চিন্তা করতে পারে না। কো-অপারেটিভ সোসাইটি করে কৃষিপণ্য কৃষকরাই সরাসরি শহরে পৌঁছে দেয়; তাই সেসব দেশে তৃতীয় পক্ষ ফঁইড়া বলা কোন সুবিধাভোগি সৃষ্টি হয় না।

দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার এত বছর পরও এদেশের কৃষক এখনো অনেক অবহেলিত। তুলনামূলক নগরের চেয়ে গ্রামের উন্নয়ন অনেকটা মন্থর গতির।  গ্রামে গড়ে উঠেনি তেমন কোন ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার প্রতিষ্ঠান। যার ফলে এখনো গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ শহরে ছুটছে। বিগত কয়েক বছর ধরে গ্রামে যান্ত্রিক সভ্যতার সাথে সাথে শিল্পায়ন, নগরায়ন কিছুটা হলেও হয়েছে, হচ্ছে। তবে, এমন অপরিকল্পিত নগরায়ন আমাদের হয়তো দিয়েছে অল্প কিছু, কিন্তু কেঁড়ে নিয়েছে নিচ্ছে অনেক কিছু। তাই আজ হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে পুরো নগরবাসী। ছোট্র যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগেও নগরবাসীর জীবনে নেমে আসে চরম ভোগান্তী। আমাদের গ্রামেও নতুন করে নগরায়নের ছোঁয়া লেগেছে, বেঁচে থাকলে হয়তো কয়েক বছরেই দেখবো পুরো এলাকাটি শহরে পরিনত হয়ে গেছে। তাই হয়তো সবাই এখন আমরা আবার ফিরে আসতেও চাইছি গ্রামে, এবার এসে সব কিছু দেখে শুনে তাই মনে হচ্ছে। ঈদ গাঁ-তে অনেককেই দেখলাম।

আমরা যখন ছোট ছিলাম নিরবে নিবৃতে ক্ষেতের আইলে বাড়ির ঘোঁপে বা পুকুড় পাড়ে একা আনমনে বসে কত কি ভাবতাম। নগরে বসবাস করে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেকটা ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্টে গড়ে তুলেছি। তারা এখন অন্য রকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাদের জীবনে ঈদের কোন আলাদা উচ্ছাস নেই; অন্যান্য ছুটির দিনের মতোই যেন একটি দিন! আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনকার ঈদ ও ঈদের আনন্দটা ছিল সম্পূ্র্ণরূপে অন্য রকম এক আবেগ অন্য রকম এক অনুভূতির একটি ব্যাপার, এখনকার ছেলে-মেয়েরা যা কল্পনাও করতে পারে না পারবে না। 

কেমন ছিল আমাদের ছোট বেলার সেই ঈদ? সূর্য উঠার অনেক আগে, বলতে গেলে সুবেহ সাদিকের অনেক আগে আমরা সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠতাম, দল বেঁধে পাশের গ্রামে (বর্তমান বসতি) কলা পাতা কাটতে যেতাম। কলা পাতা কেটে বাড়ির পুকুরে ধুয়ে ছোট  সাইজ করে বাঙলা ঘরের বারান্ধায় রেখে নিজেরা গোসল সেরে নতুন কাপড়চোপড় পড়ে পাটি ও চাদর নিয়ে ঈদগার দিকে ছুটতাম। আমাদের ঈদগাটি সম্পূর্ণরুপে আমাদের পারিবারিক। অবশ্য এখানে আশেপাশের বেশ কয়েক বাড়ির লোকজন ঈদ জামাতে শরীক হতেন, হন; সেই হিসেবে আমাদের  একটা আলাদা সমাজও গড়ে উঠেছে।
নামাজ শেষে কোলাকোলি করতে করতে গ্রামের সবাইকে নিয়ে আগে আমরা বাড়ি ফিরতাম। সমাজের প্রত্যেকে ঈদগা থেকেই হাসি মুখে প্রথমে আমাদের বাড়ি আসতেন এবং কলা পাতায় ফুল পিঠা পাতা পিঠা ক্ষীর (মিষ্টান্ন) ও ডাল খিচুরী  খেয়ে শেষে মুখে পান নিয়ে সবাই যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিতেন। আমরা বাড়ির সবাই মিলে মেহমানদারী করতাম। এটাই ছিল আমাদের বাড়ির ঈদগার ঈদের দিনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। 

আমরা বেশির ভাগই এখন আর বাড়িতে স্থায়ী নই; তাই বাড়িঘরের অবস্থাও সেই আগের মত নেই, ঘরগুলোও অযত্ন অনাদর অবহেলায় অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে। সেই সব সামাজিক আচার অনুষ্ঠানগুলোও তাই এখন আর বলবৎ নেই। আমাদের বাড়ির বেশিরভাগই গ্রামে এখন দু'দিনের অতিথি! 
তবে, শেষ বিদায়ের পর কিন্তু আমাদের বাড়ির সবাইকেই ঈদগা-র পাশের আমাদের পারিবারিক গোরস্থানেই সবার শেষ বিছানা হয়। এই জন্য বাড়ির সবাই মিলে শেষ ঠিকানা ও ঈদগাটাকে বেশ উন্নত করেছি শুধু। বাড়িঘরে মানুষ না থাকলে যেমনটি হওয়ার তেমনই হয়েছে! পুরোন বাড়ির পুকুড়টিকে মনে হলো অস্তিত্বহীন! আমি যে ঘরে জন্মেছিলাম সে ঘরটি যেন কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কোন রকম দাঁড়িয়ে আছে।

নাড়ির স্পন্দন থেমে গেলে জীবন যেমন বাঁচে না, নাড়ির টান না থাকলে তেমন গ্রামও কারো কাছে ভাল লাগবে না। গ্রাম ভালোবাসতে পারলেই বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করা সহজ হবে। নাড়ির স্পর্শ গ্রামের ছোঁয়া যার হৃদয়কে প্রকম্পিত করে না, আমি জানি না সে জন কেমন মানুষ? একমাত্র সেইসব হৃদয়হীন অমানুষরাই পারে মানুষের স্বপ্ন এক নিমিষে ধুলিস্যাত করে দিতে, রূপাদের মেরে ফেলতে।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন