রক্ত মাংস আর হাড্ডি দিয়ে গড়া মানুষ নামের এই অদ্ভুত সৃষ্টি আসলে একটি জটিল মেশিন; পরিণত অবস্থায় মানবদেহের কোষের সংখ্যা থাকে গড়ে প্রায় ৩৭.২ ট্রিলিয়ন। এ মেশিনের কলকব্জা সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা বলি— ভালো আছি সুস্থ আছি, না থাকলে— অসুস্থ। কিন্তু রক্ত-মাংস--হাড্ডি ছাড়াও তো এ মেশিনে আরও একটি জিনিস আছে, যা না থাকলে হয়ে যায় লাশ। ওই জিনিসটার কদর আমরা কতটা কি করি? তার সুস্থতা নিয়ে-ইবা আমরা কতটা ভাবি? সেই জিনিসটা সুস্থ না থাকলে শারীরিক সুস্থতার কি-ইবা দাম আছে? শুধু শরীর ভালো রেখে কি হবে? বা ওটা ভালো না রেখে শুধু শরীর ভালো রাখা কি আদৌ সম্ভব? হলেওবা কতটা কি?? এসব কি কখনও ভেবে দেখেছি?? কত জন কত কি করে সম্পদ করেছি করছি, প্রাসাদ গড়েছি গড়ছি; কিন্তু শান্তি কই?? সুখ কই?? সুস্থতা কই??
সুখ-শান্তির মূল উৎস হলো সুস্থতা, সুস্থতা আসলে কি? শুধুমাত্র শরীরে রোগের অনুপস্থিতিই কি সুস্থতা?? সুস্থতা আসলে মানুষের আত্মিক, মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক ভালো থাকার একটি নির্দেশ; যা সার্বজনীন। আবার, অসুস্থতা বলতে সাধারণভাবে আমরা শুধুমাত্র শারীরিক চিকিৎসার অংশটুকুই বুঝে নেই; রোগ-শোক বুঝি। আসলেই কি তাই? প্রকৃত সুস্থতা নির্ভর করে মানুষের শারীরিক-মানসিক, রাষ্ট্রীয়- আন্তর্জাতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সার্বিক পরিস্থিতির ওপর; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ধারণাকেই সমর্থন করে।
সুস্থতা আসলে এক মহামূল্যবান সম্পদের নাম; সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তা যে কত মূল্যবান অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কেউই বুঝতে বা অনুধাবন করতে পারি না। অসুস্থতা বা রোগ-বালাই এ জগতে কেউই কামনা করি না, তবুও নানা সময়ে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি; উদাসীনতা, বেখেয়ালিপনা, জীবন ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধে অসচেতনতাই অনেকের সার্বিক দুর্বলতা ও রোগ-বালাইয়ের প্রধান কারণ। জ্ঞান ও সচেতনতা মানুষকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাও তাদের সুস্থ রাখেন যারা স্বাস্থ-সচেতন।
সাধারণত সুস্থতার জন্য মানুষের প্রয়োজন পরিমিত খাদ্যাভ্যাস ও পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম, আর ঐশী কৃপা; এসব প্রতিটি জিনিসই এবাদতের মাধ্যমে হাসিল করা যায়। খাদ্যের জন্য দরকার সুষম খাদ্য, আর বিশ্রামের জন্য গভীর ঘুম। আর ঘুমের জন্য সবচেয়ে উত্তম ও উপযোগী সময় হলো রাত; কেননা আল্লাহ তা'আলা রাতকে বিশ্রামের উপযোগী করেই সৃষ্টি করেছেন; মহান রাব্বুল ইজ্জত বলেন, ‘আমি তোমাদের বিশ্রামের জন্য নিদ্রা দিয়েছি, তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছি আবরণস্বরূপ আর দিনকে বানিয়েছি তোমাদের কাজের জন্য।' —(সুরা : নাবা : ৯-১১)
কি এক কঠিন জামানায় এসে উপনীত হলাম, হাতের দুই আঙুলের মাঝে চলে এসেছে এখন সমগ্র বিশ্ব; বিছানায় শুয়ে শুয়ে জগৎ দেখছি, পড়ছি, লিখছি। কোন দিক দিয়ে রাত চলে যায় আর সূর্য উঠে টেরই পাই না! অথচ সূর্য উঠা-ডুবার সাথে সকল সৃষ্টির রয়েছে গভীর সব সম্পর্ক। অবশ্য রাত জাগা কিছু মানুষের জন্য খাস, সবার জন্য নয়; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার রহমত প্রাপ্ত একান্ত খাস বান্দারা এবাদত-বন্দেগীতে রাত জাগেন, সে এক অন্য রকম খেলা; আশিক-মাশুকের খেলা। অথচ বর্তমান দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষই রাতকে বানিয়েছে দিন, দিনকে রাত! সারারাত জেগে তারা ফজরের আগে আগে ঘুমায়, জাগে দুপুরে!
ফজরে ঘুমিয়ে যারা জাগছেন দুপুরে - ঘুমিয়ে কাজা যারা করছেন ফজর, তখনো জাগেননি যখন যোহর — ওনাদের সুস্থতার জিম্মা কে নেবেন? অথচ একজন ঈমানদার মুসলিমের জন্য ফজরের নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম; সকল মু'মিনের দিনের শুভক্ষণ শুরু হয় ফজরের মাধ্যমে। যে ব্যক্তি যথা সময়ে ফজরের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে দিনের সূচনা করেন রবং অতঃপর দুনিয়া শুরু করেন, ওই ব্যক্তির সুস্থতার জিম্মাদার তো স্বয়ং রাব্বুল ইজ্জত। ওই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে? তাছাড়া সকালে ঘুমিয়ে থাকার কুফল বলে শেষ করা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক গবেষণা বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের তথ্য মতে, যখন সূর্যের আলো থাকে না তখন শরীরকে কাজ করতে বাধ্য করা বা জাগিয়ে রাখা শরীরে মেলাটনিন হরমোন তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে সত্য, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সুস্থতা; প্রকৃতির প্রতিকূলে চলে উপহার পেয়েছি একটি রোবটিক জীবন, আর রোগশোক।
'সুস্থতা' আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দেয়া একটি মহা মূল্যবান নেয়ামত। একজন মানুষ কতটা সময় সুস্থ থাকবেন আর কতটা সময় অসুস্থ, তা একমাত্র গাফুরুর রাহীম-ই জানেন; এখন যে সুস্থ কিছুক্ষণ পরই হয়তো তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তাইতো হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থতা নামের এই মহা নেয়ামতের কদর করতে জোরালো তাগিদ দিয়েছেন ; হাদিসে বর্ণিত, ‘তোমরা পাঁচটি অবস্থায় পতিত হওয়ার পূর্বেই জিনিসগুলোকে কদর করো, মূল্য দাও— ১). বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বে যৌবনকে, ২). রোগ আক্রমণের পূর্বে সুস্থতাকে, ৩). কর্মব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে, ৪), মৃত্যু আসার পূর্বে জীবনকে, এবং ৫). দারিদ্রতা আসার পূর্বে স্বচ্ছলতাকে।' বোখারী শরীফের অন্য আরেক হাদিসে এসেছে, ‘দুটি নেয়ামতের বিষয়ে মানুষ ক্ষতির মাঝে থাকে— ১). সুস্থতা, ও ২). অবসর।'
সুস্থ থাকতে থাকতে নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হতে বলেছেন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; ইসলামি স্কলারগণও শারীরিক সুস্থতার জন্য ইসলামি নির্দেশিত পন্থায় জীবন পরিচালনার পাশাপাশি আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার দরবারে বেশি বেশি দোয়া করতে বলেছেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত— আমি আমার পিতাকে বললাম, আব্বাজান! আমি আপনাকে প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় তিনবার বলতে শুনি যে আপনি এই দোয়া "আল্লাহুম্মা আ-ফিনি ফি বাদানি, আল্লাহুম্মা আ-ফিনি ফি সাম-ই, আল্লাহুম্মা আ-ফিনি ফি বাসারি, লা-ইলাহা ইল্লা আনতা" পাঠ করছেন। তিনি বলেন, আমি হুজুরপাক (সাঃ)-কে এ বাক্যগুলো দ্বারা দোয়া করতে শুনেছি। সে জন্য আমিও তাঁর (সাঃ) নিয়ম অনুসরণ করতে ভালোবাসি। —(সুনানে আবু দাউদ : ৫০৯০)
মানব-আত্মার সুস্থতার জন্য সুস্থ ও সুঠাম দেহ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; শারীরিক সুস্থতা মানুষের আত্মিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির সোপান। দেহ ও মনকে প্রফুল্ল রাখতে সুস্বাস্থ্যের ভূমিকা অপরিসীম। আর এ জন্য শারীরিক কসরত বা ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। শরীরে কোন রোগ-বালাই না থাকলেও সুস্থতা ধরে রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মত হলো, কায়িক পরিশ্রম না করা মানুষের প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিন অন্ততঃ ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ দিন ব্যায়াম করা। ইসলামও তাই বলে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন— শরীরচর্চার আদর্শ সময় আসলে কোনটি, সকাল, দুপুর নাকি বিকেল? ইসলামি জীবন বিধান বলে— সকাল; ফজরের পর হাটাহাটি করা সবচেয়ে উত্তম। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায়, দিনের যে কোনো সময়ের পরিবর্তে সকালে ব্যায়াম করলে অনেক বেশি কাজ হয়; সকালে ব্যায়াম করলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
সকালবেলা শরীর কার্বোহাইড্রেটের বদলে ফ্যাট বা চর্বিকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে; কেননা বেশির ভাগ কার্বোহাইড্রেট বা গ্লুকোজ রাতের বেলা শরীরকে সাপোর্ট দিতেই ব্যবহার হয়ে যায়। তাই মেদ বা ফ্যাট কমাতে চাইলে সকালের দিকে ব্যায়াম করা সবচেয়ে উত্তম। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, তাদের উচিত প্রতিদিন সকালে শরীরচর্চা করা।সকালের শরীরচর্চায় দেহে এন্ডোরফিন নামক হরমোনের নিঃসরণ ঘটে; এই এন্ডোরফিনগুলো মস্তিষ্কের রিসেপ্টরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি করে। ফলে দিনভর মন ভালো থাকে, হতাশা থেকে মুক্তি মেলে।
সকালে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বাড়ে; এ সময় ব্যায়াম করলে পেশিগুলো শক্তিশালী হয়। সকালে ব্যায়াম করলে রাতে ভালো ঘুম হয়; যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে তারা সকালে ব্যায়াম করতে পারেন। দেহের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিসের মাত্রা কমায় সকালের ব্যায়াম। সকালে জগিং করলে বা দ্রুত হাঁটলে হার্টে বেশি পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ হয়, এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। সকালে হাঁটলে রক্তের লোহিত কণিকা থেকে চর্বি ঝরে, হাঁটার সময় রক্তের ইনসুলিন ও গ্লুকোজ ক্ষয় হয়। ফলে ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সকালের স্নিদ্ধ বাতাস থেকে অক্সিজেন হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে রক্ত বিশুদ্ধ করে এবং অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত মস্তিষ্কে সরবরাহ করে। ফলে মস্তিষ্ক সচল থাকে, ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করে, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে, মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
সকালে হাঁটাহাঁটির ফলে শরীর থেকে যে ঘাম বের হয় তাতে ত্বকের লোমকূপগুলো খুলে যায় এবং শরীরের দূষিত পদার্থগুলো ঘামের মাধ্যমে দ্রুত বের হয়ে যায়; ফলে ত্বক উজ্জ্বল ও লাবণ্যময় দেখায়। তারুণ্য ধরে রাখতে সকালের ব্যায়াম বিশেষ উপযোগী। দৌড়, জগিং, ফ্রি হ্যান্ড বা জিমে গিয়ে যা-ই হোক না কেন, সকালে ৩০ মিনিটের ব্যায়াম পুরো দিনের ব্যায়ামের চাহিদা মেটায়; সারা দিনের কর্মক্ষমতা বজায় থাকে।
তাই বলি কি— সকাল সকাল ঘুমাতে চেষ্টা করুন এবং শেষ রাতে জাগার অভ্যাস করুন, জীবন পালটে যাবে ইনশাআল্লাহ। ফজরের নামাজের পর পবিত্র কুর'আন তেলাওয়াতে অনেক বেশি ফজিলত; তাই নামাজ আদায় করে কুর'আন পড়ে কোলাহলমুক্ত সকালে বেরিয়ে পরুন, বেহেশতের বাতাসে গা শীতল করুন। এ বাতাসে হাটাহাটি বা ব্যায়াম করলে শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২১ জানুয়ারি, ২০২২.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন