মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৪

কিছু সহজ কথা :

আমরা যখন ছোট ছিলাম, সেই ছোট্টটি থেকেই মাঠ ঘাট প্রান্তর চষে বেড়িয়ে বড় হয়েছি; বৌ ছি, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, কাবাডি, ভলিবল, ফুটবল কত কি খেলেছি। কোন গাছে কোন পাখির বাসা আছে, কার গাছে কোন ফল ধরেছে, কোন গাছে কলা পেকেছে, কার গাছের আম মিষ্টি, কার মুরগী কয়টা ডিম পেড়েছে, কার গাই কোন রঙ্গের বাছুর দিয়েছে এসব ছিল আমাদের নখদর্পণে। বাবা বলতেন - বেশি বেশি সবুজের দিকে তাকাতে, মাটির দিকে চোখ রাখতে; এতে নাকি চোখের জ্যোতি বাড়ে, সহ্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 
শহরের বাচ্চারা এখন আর এসব কল্পনাও করতে পারে না; গ্রামের বাচ্চাদের মাঝ থেকেও এখন এসব হারিয়ে যেতে বসেছে, তাদের মাঝেও প্রযুক্তি নির্ভরতার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে; তারাও এখন আক্রান্ত হয়ে পরেছে স্মার্টফোন বা ট্যাব নামের এইসব মস্তিস্কের কোষ নিধনকারী ভাইরাসে; পৃথিবীর সমগ্র শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক আধুনিক প্রযুক্তি নামের এইসব যন্ত্রদানব।

অনেক বাবা-মা হয়তো যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন যুগের চাহিদা মেটাতে এসবের বিকল্প কি? প্রোগ্রামিং বাচ্চাদের মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখে,  ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু একবার ভাল করে ভেবে দেখেছেন কি, বেশিরভাগ বাচ্চারা স্মার্টফোনের কোন কোন দিকে আসক্ত?

গত বছর আমার মেয়ে যখন ইউরোপ থেকে দেশে বেড়াতে আসে তখন প্রথম প্রথম তিন বছরের নাতিকে দেখতাম সারাক্ষণ সে মোবাইলে পরে থাকছে; ব্যাপারটা আমার কাছে অসহনীয় লাগত। তিন বছরের একটা ছোট্ট শিশুর স্মার্টফোন চালানোর দক্ষতা দেখে আমার কাছে তা অনেকটা বিষ্ময়ই মনে হতো। তখনো সে লিখতে শিখেনি কেবল টুকটাক কথা বলতে শিখেছে, দেখি মুখের শব্দ দিয়ে মা'য়ের স্মার্টফোনে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও খুঁজে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন গেম বা মারপিটের ভিডিও আনছে, চুপচাপ বসে বসে ঐসব দেখছে, হাসছে বা চোখেমুখে হাতপায়ে মারামারির অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে; মোবাইল স্কিন থেকে কখনো মুখ তুলেও অন্য দিকে তাকাচ্ছে না। 
এইসব দেখে তাকে দেখিয়ে আমিও কায়দা করে আমার ফোনে কয়েকটা কার রেসের গেম ডাউনলোড করলাম এবং তাকে দেখিয়ে সেসব খেলতে শুরু করলাম; এতে দেখি সে আমার দিকে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে; তবে, মোবাইল তার চাই-ই-চাই। মেয়েকে বললাম - এ তুই কি করেছিস? ওকে স্মার্টফোনে অভিজ্ঞ করে আসক্তি করিয়েছিস কেন? 
সে যা বলল তা মোটামুটি এরকম- সারাদিন তোমাদের জামাই থাকে কাজে, আমিও নানান কাজে ব্যস্ত থাকি, ঘরে ও একা কি করবে? আমাকে সারাক্ষণ বিরক্ত করে; ফোনটা হাতে দিলে আর কোন বিরক্ত করে না। 

মেয়ের কথা শুনে আমার তো আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। ভাবতে থাকলাম এই ছোট্ট শিশুটিকে কি করে এই অসক্তি থেকে বের করে আনা যায়। প্রথমেই লক্ষ্য করলাম ইউটিউবে সে কি দেখে? দেখি, কার্টুন দেখছে নয়তো মারামারি বা  গাড়ির রেস; ভিডিও গেমস-এ কার রেসিং করছে। ভাবতে ভাবতে আমি তার সাথে মারামারি করা শুরু করে দিলাম; সেও নানীর কাছ থেকে লাঠিটাঠি যোগার করে প্রথম প্রথম আমাকে মারতে শুরু করল, আমিও পাল্টা মারের অভিনয় করতাম; ইয়া হু বলে সে আমাকে কিক মারতে শুরু করল। মেয়ে তো আমার উপর ক্ষেপেই গেল; ভাবল আমি তার ছেলেকে বেয়াদব বানাচ্ছি, খারাপ করে দিচ্ছি। দুদিন পরই দেখা গেল স্মার্টফোন আসক্তি তার অনেকটাই কমতে শুরু করেছে। এখন যখনতখন সে ইয়া হু, ডিসুম ডাসুম করে আমার উপর ঝাপিয়ে পরতে শুরু করল, ছোট্ট মুষ্ঠিতে ঘুসি মেরে আমাকে কাত করে ফেলে দিতে পারলে তার সে কি আনন্দ, হা হা করে অট্ট হাসিতে ফেটে পরছে। কয়েক দিনেই সে আমার খুব লউগ্গা হয়ে গেল। 

ইউরোপে জন্ম নেয়া রোগশোকমুক্ত দূষণমুক্ত একটি শিশু এদেশের এই বিষাক্ত আবহাওয়ায় কতটা খাপ খাওয়াতে পারে নিজেকে? সেও বেশ কিছুদিন পারেনি, বাইরে বেরুলেই তার গায়ে ফোসকা উঠে যেত; ঢাকা শহরের দূষণ তার শরীরে একেবারেই সহ্য হতো না। তারপরও একদিন মেয়েকে না জানিয়ে চুপিচুপি আমি নাতিকে নিয়ে বাইরে বের হলাম, তার ইচ্ছে মতো ফল খেলনা কিনে নিয়ে এলাম। আস্তে আস্তে নাতিকে নিয়ে প্রকৃতিতে চলে যেতাম, রিক্সায় বা হেটে দুজনে রাস্তায় বের হয়ে যেতাম। 
এভাবেই তাকে একে একে এদেশের আবহাওয়া খাদ্য মাটি ও মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলাম। বাসে চড়ার তার খুব সখ ছিল, তাই আমি মাঝেমধ্যেই ফাঁকা বাস পেলে তাকে নিয়ে এই ষ্টপিজ ঐ ষ্টপিজ করতাম। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা খেলনা তাকে কিনে এনে দিতাম এবং ওটা নিয়ে তার সাথে কিছুটা সময় খেলতাম। বেশ কয়েক মাস তারা দেশে ছিল; এরই মাঝে লক্ষ্য করলাম আগের সেইসব বদ অভ্যাসগুলো তার থেকে অনেকটা দূর হয়ে গেছে।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোন থেকে নিঃসরিত তেজস্ক্রিয় রশ্মি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আমাদের ডি এন এ-কে। কোন কারণে মস্তিষ্কের কোষের ডি এন এ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা স্নায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন শারীরিক কাজের প্রচন্ড ক্ষতিসাধন করে। শিশুদের মস্তিস্কের কোষ বা নিউরণ অত্যন্ত নরম বলে স্মার্টফোন বা ট্যাব তাদের মারত্মক ক্ষতি করছে। বিজ্ঞানী হাইল্যান্ড বলেছেন - তড়িৎ চুম্বকীয় দূষণের কারনেই বেশিরভাগ শিশুরা এপিলেপসি ও অ্যাজমারোগে ভুগছে। চোখের খুব কাছাকাছি দূরত্বে রেখে শিশুরা স্মার্টফোন বা ট্যাব ব্যবহার করে বলে ধীরে ধীরে তারা মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, শ্রবণশক্তি হ্রাস - এরকম নানান সব সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা স্মার্টফোন বা ট্যাব নিঃসরিত তেজস্ক্রিয় রঙ্গিন রশ্মি।  হূ-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমান বিশ্বে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর, তাদের মাধ্যে শ্রবণশক্তি হ্রাসের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে।

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি মানব সভ্যতা বিকাশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য; এসব ছাড়া একটি দিনও আমাদের কল্পনা করা যায় না। প্রযুক্তিই স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে মানুষকে, রোগ সুখ ভোগ তৃপ্তিতে সহজ স্পর্শ এনে দিয়েছে, কিন্তু শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রযুক্তিই।

  'আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ’ এ সত্যটা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারলেও, একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তার মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি, মেধা ও মননের বিকাশ ঘটাতে পিতা-মাতা তথা পরিবার ও সমাজের কী করা উচিত তা নিয়ে আমরা মোটেও সচেতন নই। এসবের জন্য অশিক্ষা, কুসংস্কার অজ্ঞতাই যে প্রতিবন্ধক তা কিন্তু নয়; শিশুদের প্রতি পারিবারিক উদাসীনতাই এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৮ এপ্রিল, ২০১৭.

বুধবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪

'লাইলাতুল মি'রাজ' সম্পর্কে বিজ্ঞান কি বলে?



'মিরাজ' একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে সিঁড়ি বা সোপান, ঊর্ধ্বে আরোহণ, উপরে ওঠা। 'লাইলাতুল মিরাজ' বা শবে মিরাজ বলতে আরোহণের রাত্রি বোঝায়; ইসলামিক পরিভাষায়- এটা সেই রাত্রি যখন হুজুরপাক (সাঃ) মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে জেরুসালেমের বায়তুল মুকাদ্দিসে যান, এবং সেখান থেকে সপ্ত আসমান ভ্রমণ করেন ও আল্লাহর সন্নিকটে পৌঁছান। এ ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার আগে যে কোন মুসলিমের ইসলামের মূল ভিত্তি পবিত্র কুরআন-হাদীস থেকে এ বিষয়ে  আগে ভালো করে জানা উচিত, এবং তা সত্য বলে মেনে নেয়া জরুরী। কারণ, 'মিরাজ' ঈমানের ভিত্তমূলের একটি বিষয়; তারপরে তাকানো উচিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। অনেকের অনুরোধে আজ আমি 'মিরাজ' নিয়ে সংক্ষেপে এর দু'একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। 

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বটি হলো- স্থান, কাল ও জড়/ভর ধ্রুবক বা পরম কিছু নয়, এ'গুলো আপেক্ষিক; এ তত্ত্বকে বলা হয় আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জগৎ বিখ্যাত এই তত্ত্ব- E=mc^2 নামে খ্যাত; এ সূত্র দ্বারা প্রধানত শক্তি ও ভর সমতুল্য বোঝায়।সূত্র অনুসারে m ভরের কোন বস্তুতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ ঐ ভরের সাথে আলোর বেগ(c)-এর বর্গের গুনফলের সমান; অর্থাৎ ১ কেজি ভরের কোন বস্তুতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ ৯০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ জুল বা নব্বই মিলিয়ন বিলিয়ন জুল।
E=mc^2 সমীকরণটি শক্তির সাথে ভরের একটি চমৎকার সম্পর্ক নির্দেশ করে। এটি থেকে বোঝা যায় যে, শক্তি এবং ভর আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, ভর থেকে শক্তি পাওয়া যায় এবং শক্তি থেকেও ভর পাওয়া যেতে পারে; অর্থাৎ শক্তি এবং ভর পরস্পর সমতুল্য।

পদার্থ বিজ্ঞানের এ তত্ত্ব থেক যা বুঝা যায়-
১.পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুববেগে ধাবমান সকল রেফারেন্স ফ্রেমে পদার্থ বিজ্ঞানের যে কোন সূত্র একই রকম সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা যায়। 
২. শূণ্যস্থানে বা বায়ু মাধ্যমে আলোর বেগ ধ্রুব এবং এ বেগ আলোর উৎস ও পর্যবেক্ষকের আপেক্ষিক বেগের ওপর নির্ভরশীল নয়। 
তাই, কোন বস্তু থেকে বিকিরিত আলো আমাদের চোখে এসে পৌঁছালেই আমরা তাকে কিছু পরে দেখতে পারি, যেমন সূর্যকে আমরা প্রকৃতপক্ষে ৮ মিনিট পরে দেখি। 

'লাইলাতুল মিরাজ' বিজ্ঞানের এক অবিস্মরণীয় বিষ্ময়- প্রথমতঃ মিরাজ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর একটি মু'জেজা বা মিরাকল। মু'জেজা বা মিরাকল আসলে এমন একটি বিষয় যা বুদ্ধিবৃত্তিক মানবীয় ব্যাখ্যা দিয়ে আয়ত্ব করা যায় না বা সম্ভব নয়; আর যদি মিরাকল কে মানুষ বুঝেই ফেলে তবে সেটা আর মিরাকল থাকলোইবা কি করে? 
মিরাজের রাত্রিতে কি ঘটেছিল? প্রথম পর্ব- সুরা বণী ইসরাইলের ১ নং আয়াত- 'পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।" দ্বিতীয় পর্ব- সুরা নাজম-এর ১৩-১৮ আয়াত- "নিশ্চয়ই..................................
নিশ্চয় তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।"

৬২২ খৃষ্টাব্দের ২৭ রজবের মধ্যরাতে জিবরাঈল (আঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে এলেন 'বুরাক' নামক বাহন নিয়ে (বুরাক শব্দটির অর্থ বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রিসিটি শব্দের সাথে সম্পর্কিত), রাসুল (সাঃ) এ সময় ঘুমিয়ে ছিলেন। হযরত  জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আল্লাহর ম্যাসেজ পৌছে দিলেন, পরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বক্ষ পুনরায় বিদীর্ণ করে জমজমের পানি দিয়ে ধোয়া হলো; হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী রাসুল (সাঃ)-এর বক্ষ (অন্তর) প্রজ্ঞা এবং আলো [ইংরেজীতে wisdom ও splendour (special light 'Noor')] দিয়ে পূর্ণ করে দেয়া হলো, এর পর রাসুল (সাঃ) হাউজে কাউসরের পানিতে গোসল করেন।

মিরাজের যাত্রার দুটি অংশ- প্রথমটি আনুভূমিক, দ্বিতীয়টি উলম্ব বরাবর; প্রথম অংশটিকে ইসরা বলা হয় [এসময়ের ভ্রমণটি ছিলো বায়তুল্লাহ (কাবা) থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত], বায়তুল মুকাদ্দাসে (মসজিদুল আকসা-ফিলিস্তীন) আল্লাহ তায়ালা সকল নবীর সমাবেশ ঘটান; ওখানে সকল নবী এবং ফেরেস্তাগণ সম্মিলিতভাবে ২ রাকায়াত নামাজ আদায় করেন, নবী মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ঐ জামাতের ইমামতি করেন।

ওখান থেকে শুরু হয় উর্ধ্বমূখী যাত্রা, মানুষের কল্পণার অতীত গতিতে বোরাক ছুটে চলে মহাশূণ্যের দিকে। আকাশের প্রতিটি স্তরে প্রধান ফেরেস্তাগণ এবং নবীদের সাথে সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হয় রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে। ১ম স্তরে হযরত আদম (Adam) (আঃ), ২য় স্তরে হযরত ইয়াহিয়া (John) (আঃ) এবং হযরত ইসা (Jesus Christ) (আঃ), ৩য় স্তরে হযরত ইউসুফ (Joseph) (আঃ), চতুর্থ স্তরে হযরত ইদরীস (Enoch) (আঃ), পঞ্চম স্তরে হযরত হারুন (Aaron) (আঃ), ষষ্ঠ স্তরে হযরত মুসা (Moses) (আঃ) এবং সপ্তম স্তরে হযরত ইব্রাহীম (Abraham) (আঃ) মুহাম্মদ (সাঃ)-কে স্বাগতম জানান....... 
হযরত জীবরাইল (আঃ)-এর বোরাক পরিচালনায় রাসুল (সাঃ) সিদরাতুল মুনতাহা নামক স্থানে এসে পৌঁছলে উর্ধ্বমূখী যাত্রার দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয়। এ পর্যায়ে হযরত জীবরাঈল (আঃ) পরবর্তীতে আর অগ্রসর হতে অপারগতা প্রকাশ করলেন; বাহন পরিবর্তন হয় ওখানে। রফরফ নামক আরেকটি যান রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে আল্লাহর নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নেয়।

স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন তার স্পেশাল থিওরী আব রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন ১৯০৫ সালে এবং জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন ১৯১৭ সালে। এখানে সাধারণভাবে একটা প্রশ্ন মনে আসে, তাহলো- কেন তিনি স্পেশাল থিওরী জেনারেল থিওরীর আগেই প্রকাশ করেন? এর পিছনের কারণ কি?? জানা নেই কারো। থিওরীর প্রথম স্বীকার্য: Special Principle of Relativity - The laws of physics are the same in all inertial frames of reference. In other words, there are no privileged inertial frames of reference. 
দ্বিতীয় স্বীকার্য: - Invariance of 'C' - The speed of light in a vacuum is a universal constant, c, which is independent of the motion of the light source. 

এ থিওরী থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নিন্মে তুলে ধরছি-

১. Time dilation (সময় দীর্ঘায়ণ): একই ঘটনায় স্থির কোন স্থানে পরিমাপকৃত সময়ব্যবধান ধ্রুববেগে গতিশীল স্থানে পরিমাপকৃত সময় ব্যবধানের চাইতে বেশি (অর্থাৎ রুমে বসে ব্লগ লিখতে ৩ মিনিট সময় লাগলে, কোন মহাকাশযানে বসে লিখতে হয়তো তাতে ১ মিনিট লাগবে- ব্যাপারটা এ'রকম)।
২. Relativity of simultaneity : মনে করুন, আপনি কোথাও দাড়িয়ে একই সাথে ২ টি ঘটনা ঘটতে দেখছেন, কিন্তু ওই ঘটনা দুটিই অন্য কোন স্থান ( ধরুন, গতিশীল) থেকে অন্য কেউ একই সাথে ঘটতে দেখবে না, সে দেখবে একটি ঘটনা শেষ হবার পর বা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর আরেকটি শুরু হয়েছে। 
৩. Lorentz contraction : একই বস্তুর ডাইমেনশন (দৈর্ঘ্য, উচ্চতা..) গুলো দুটি ভিন্ন গতিতে গতিশীল স্থান থেকে মাপলে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপ পাওয়া যাবে । 
৪. বস্তু গতিশীল হলে এর ভর বৃদ্ধি পাবে।
৫. E = mc² ......... ভর আর শক্তি একই সত্তার ভিন্ন রূপ এবং রূপান্তরযোগ্য । 

মি'রাজ ও স্পেশাল থিওরী অব রিলেটিভিটি-র কিছু বৈসাদৃশ্য ও সাদৃশ্যের উদাহরণ নিন্মে তুলে ধরছি: 

১. রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর উর্ধ্বগমনের সম্ভ্যাব্যতার ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই; যেহেতু মহাকাশ ভ্রমন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক থিওরী আজকাল অনেক পুরোনো হয়ে গেছে, তারপরও মিরাজ নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, তাদের জন্য উত্তর- Allah is Almighty, আল্লাহু ওয়া রাসুলুহু আলম, তিনি সবকিছুই নিমিষে করতে পারেন। 

২. এ থিওরী অনুযায়ী অন্তত একজন হলেও লাইট-স্পিড বা এর চেয়ে বেশি গতিতে ভ্রমণ করতেই হবে, আইনস্টাইনের সূত্রকে বাস্তবতা দেয়ার স্বার্থে হলেও; ধরে নেই সেই ভ্রমণকারী হুজুরপাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাছাড়া স্পেশাল থিওরী অব রিলেটিভিটির- টাইম-স্পেস ভেলোসিটি রিলেটেড; তাই আলোর গতির সমান গতিতে চললেই সময় স্থির হয়ে যাবে খুব সহজে; তখন সময়কে ধরে রেখে যতখানি ইচ্ছে কাজ করে নেয়া সম্ভব। Time dilation  এবং Relativity of simultaneity মূলতঃ এই দুটি ফলাফল এ ঘটনার ব্যাখ্যা। 

 ৩. মহাবিশ্ব ভ্রমণ শেষে রাসুলপাক (সাঃ) দুনিয়ায় ফিরে এসে দেখতে পান, দরজার শেকল ঠিক আগের অবস্থানে দুলছে, এত বিশাল স্থান অতিক্রম করার পরেও সময়ের কোন হেরফের কিভাবে না হয়ে পারে? এর উত্তর নিশ্চয় এখনই স্পষ্ট হয়ে যাবে- সুরা বাকারার ২৫৯নং আয়াত- "বা তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখ নাই, যে এমন এক নগরে উপনীত হয়েছিল যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সে বলল, ‘মৃত্যুর পর কিরূপে আল্লাহ্ একে জীবিত করবেন ?’ তারপর আল্লাহ্ তাকে একশত বৎসর মৃত রাখলেন। পরে তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ্ বললেন, ‘তুমি কত কাল অবস্থান করলে ?’ সে বলল, ‘এক দিন বা এক দিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি।’ তিনি বললেন, ‘না, বরং তুমি একশত বৎসর অবস্থান করেছ। তোমার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য কর, এটা অবিকৃত রয়েছে এবং তোমার গর্দভটির প্রতি লক্ষ্য কর, কারণ তোমাকে মানবজাতির জন্যে নিদর্শনস্বরূপ করব। আর অস্থিগুলির প্রতি লক্ষ্য কর; কিভাবে সেগুলিকে সংযোজিত করি এবং গোশত দিয়ে ঢেকে দেই।' যখন এটা তার নিকট স্পষ্ট হল তখন সে বলে উঠল, ‘আমি জানি যে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’"  মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য এ এক মহা নিদর্শন। এখানে মহান আল্লাহর বিজ্ঞানময় প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে; এ আয়াত বিশ্ব মানবতার জন্য মহান রবের মহান এক শিক্ষা। 

৪. আলো ১ বছরে ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার পরিমান স্থান অতিক্রম করতে পারে এবং বলা হয় পৃথিবীকে কেন্দ্র ভাবলে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ৪৬.৫০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ; অর্থাৎ আলোর গতিতে চললেও এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে এত বিশাল সময়ের প্রয়োজন। যদিও মহাবিশ্বের সত্যিকার ব্যাস আরো অনেক অনেক বেশি। তো, প্রশ্ন দাড়ালো রাসুল (সাঃ) কিভাবে এত বিরাট সময়কে অতি অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারলেন? উত্তর : স্পেশাল রিলেটিভিটি থিওরী থেকে প্রাপ্ত লরেন্জ কন্ট্রাকশন ফলাফল এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি; এর ফলাফল অনুযায়ী গতিশীল অবস্থানে দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ রাসুলপাক (সাঃ)-এর গতির কারণে মহাবিশ্বের বিশাল দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে গিয়েছিলো। তারপর সেই একই কথা- আল্লাহ ই ভালো জানেন , আসলে সেদিন কি ঘটিয়েছেন।

৫. E=mc^2 সূত্র অনুযায়ী কোন বস্তু আলোর গতিতে চলমান হলে তা বস্তু থেকে শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে যাবে। এই শক্তি যখন পুনরায় বস্তুতে রুপান্তরিত হয় তখন কিছু পরিমান লস হবে, যা mass defect বলে পরিচিত। কোন জীবন্ত শরীর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে নাকি তার শারীরীক কিছু পরিবর্তরণ হওয়া উচিত; যেমন শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবস্থান পরিবর্তন। কিন্তু মিরাজের ক্ষেতে এমনটা হয়নি কেন? উত্তর : এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট  মনে করিয়ে দিতে চাই মি’রাজ একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা যা বাস্তবে ঘটেছিলো, এটি কোন তত্ত্ব বা থিওরী বা সূত্র বা ধারণা নয়, এটি বাস্তবতা। যেমন সুরা নামলের ৪০ নং আয়াত- "কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, ‘আপনি চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দিব।’ সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত অবস্থায় দেখল তখন সে বলল, ‘এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন-আমি কৃতজ্ঞ না অকৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজেরই কল্যাণের জন্যে এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে, আমার প্রতিপালক।" একজন সুফী যদি হাজার মাইল দূর থেকে একটা রাজকুরসীকে নিমিষে তুলে আনতে পারেন, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠর সাথে তাঁর মালিকের দীদার নিমিষে (এক পলকে) কেন সম্ভব নয়?

তাছাড়া যেকোন বৈজ্ঞানিক সূত্র বাস্তবে সত্য হতে হলে কিছু শর্ত সম্পন্ন করতে হয়, খুব সাধারণ কিছু ব্যাপার লাগে—উদাহরনস্বরূপ বলা যায়,বস্তুর ক্ষেত্রে অবস্থান-ভর-তাপ-চাপ ইত্যাদি.....  তা থেকে যতটুকো অনুভব করা যায়; মিরাজে আইনস্টাইনের থিওরীর এই অংশকে অতিক্রম করা হয়েছিলো কিছু পূর্বপ্রস্তুতির মাধ্যমে, যাত্রার পূর্বে মহানবী (সাঃ)-এর বক্ষ বিদীর্ন করা, অন্তর প্রজ্ঞা ও নূর দিয়ে পূর্ণ করে দেয়া..... এসবের সত্যিকারের রহস্য শুধুমাত্র বিজ্ঞান দিয়ে কাল কিয়ামত পর্যন্ত কেউ উন্মুক্ত করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না........।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৩১/০১/২০২৩.