হযরত হাসান (রাঃ) ছিলেন খুলাফায়ে রাশেদীনের পঞ্চম খলিফা; যার প্রমাণ মেলে এই হাদিস থেকে, "আমার পরে খেলাফতনীতি বহাল থাকবে ৩০ বছর; তারপর শুরু হবে রাজতন্ত্র।"—(দালাইল-ই নুবুওয়াত)। হযরত হাসান (রাঃ)-র শাসনামল যোগ করলে খেলাফত কাল মোট ৩০ বছর পূর্ণ হয়; রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত ১১ হিজরি'র রবিউল আউয়াল মাস, আর ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে হযরত হাসান (রাঃ) ও মু'য়াবিয়া (রাঃ)-র মধ্যে সন্ধিচুক্তি হয়। চার শর্তে— 'মুয়াবিয়া আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নত অনুসারে কাজ করবেন; মুয়াবিয়া তার উত্তরাধিকারী নিয়োগ করতে পারবেন না, তবে একটি নির্বাচন পরিষদ (শূরা) থাকবে; জনগণ যেখানেই থাকুক না কেন তারা নিজেরা, তাদের সম্পত্তি এবং তাদের বংশধরেরা নিরাপদ থাকবে; মুয়াবিয়া গোপনে বা প্রকাশ্যে হাসান বা আলি (রাঃ)-র বংশধরদের বিরুদ্ধে কোন অন্যায় করবেন না এবং সাহাবীদের কাউকে ভয় দেখাবেন না।'— হযরত হাসান (রাঃ) খেলাফত থেকে সরে দাঁড়ান।
এর আগে হযরত আলি (রাঃ) আহত থাকা অবস্থায় লোকজন তাঁকে বলেছিল, হে আমিরুল মু'মিনীন! আপনার পরে খলিফা কে হবে তা নির্ধারিত করে দিন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, "না, তা আমি করবো না, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে যেমন খলিফা না করে রেখে গিয়েছিলেন আমিও তেমনই রেখে যাবো। মহান আল্লাহ যদি তোমাদের কল্যাণ চান তাহলে তোমাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠতম, তাঁর খলিফা নির্ধারণে তিনিই তোমাদের ঐক্যবদ্ধ করে দেবেন, যেমন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরে উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির খলীফা নির্বাচনে তিনি তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছিলেন।"
খলিফাতুল মুসলিমীন ইন্তেকাল করলেন, তাঁর জেষ্ঠপুত্র হযরত হাসান (রাঃ) তাঁর জানাযার নামাজে ইমামতি করলেন। দাফন-কাফন শেষে সময়ের পরিক্রমায় গুরুত্ব বিবেচনায় সর্বপ্রথম আজারবাইজানের গভর্ণর কায়স ইবনে সা'দ ইবনে উবাদা (রাঃ) হযরত হাসান (রাঃ)-র সন্মুখে এলেন এবং বললেন, "আপনার হাত প্রসারিত করুন। আল্লাহর কিতাব ও রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাত বাস্তবায়নের মর্মে আমরা আপনার হাতে বায়'আত করবো।" এরপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-র আহবানে উপস্থিত লোকজন একে একে বায়'আত নিতে থাকেন; মুয়াবিয়া (রাঃ) শাসিত শ্যাম ছাড়া সমগ্র মুসলিম জাহানের গভর্ণরগণ ও সাধারণ লোকজনও এসে দলে দলে খেলাফতের বায়'আত গ্রহণ করেন।
খেলাফত থেকে রাজতন্ত্র- সে এক দীর্ঘ পরিক্রমা। তাই কোন ভূমিকা ছাড়াই শুরু করলাম; কারণ বহুদূর যেতে হবে, আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা যেন তৌফিক দান করেন। আমরা বর্তমান মুসলমানরা না বুঝেই ইসলামের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করি; অথচ পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফের বেশির ভাগ আয়াতই ইতিহাস বর্ণনায় ব্যবহৃত। যে'সব ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার দীক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং মা'বুদ মাওলা। দুনিয়ার বর্তমান মুসলিম প্রজন্ম ইতিহাস অবজ্ঞা করার বহুবিধ কারণ রয়েছে; মূল কারণ, জ্ঞানের স্বল্পতা; তথ্য থেকে সঠিক ঘটনা না বের করতে পারার ব্যর্থতা বা না বুঝতে পারা বা সঠিক ইতিহাস জাস্টিফাই করতে না পারার প্রবণতা। আমি নিজেও এক সময় এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলাম। ইসলামের সঠিক ইতিহাস জানতে গিয়ে জীবনে কত রাইটারের বই যে পড়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই; শেষ পর্যন্ত পেয়েছি এবং পেরেছি! জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যা আবিষ্কার করেছি সে'সবের নির্যাসই আজ আপনাদের জন্য তুলে ধরার ইচ্ছে পোষণ করছি। জ্ঞানপিপাসুদের জন্য লেখাটি হয়তো জোনাকিপোকা হয়ে উঠতে পারে (এ লেখার অনেক কিছুই বিভিন্ন কিতাব থেকে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে)।
তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটা বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায়, ক্ষমতার লোভে উমাইয়ারা তখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল; মুসলিম সাম্রাজ্যের আনাচেকানাচে আচমকা গুপ্ত হত্যা ও রাহাজানি চরমভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় খলিফার বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরে তারা ইসলামের বারোটা বাজিয়েছিল শুধুমাত্র দুনিয়ার ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে; আর তা বুঝতে পেরেছিলেন হযরত হাসান (রাঃ)। তিনি মনে করেছিলেন মুসলমানে মুসলমানে রক্তপাত আর কত ঘটবে? তা বন্ধ করতে তাঁর মসনদ থেকে সরে যাওয়া উচিত; তিনি তা করেও ছিলেন। অনেকের মতো এ সিদ্ধান্তে তাঁর আপন ছোটভাই হযরত হোসাইন (রাঃ)-ও দ্বিমত পোষণ করেছিলেন; কিন্তু হাসান (রাঃ) ছিলেন অটল। মুসলিম বিশ্বকে গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্ত করে একক শাসন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে সে সময়ে হযরত হাসান (রাঃ) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমার বিবেচনায় তা যুগান্তকারী এবং সঠিক। অনেকের অভিমত মুয়া'বিয়া (রাঃ) হযরত হাসান (রাঃ)-এর চেয়ে খেলাফতের যোগ্যতর ছিলেন বলে হাসান (রাঃ) তার কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেন, প্রকৃতার্থে মোটেও তা না; সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ইসলামের বৃহত্তর ও মহান স্বার্থে।
সুরা তওবা'র ১০০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা স্পষ্ট ঘোষণা করেন—"ওয়সসা-বিকুনাল আওয়্যালূনা মিনাল মুহা-জ্বিরীনা ওয়াল আনসা-রি ওয়ালল্লাযীনাততাবা‘ঊহুম বিইহ সা-নির রাদ্বিয়াল্লা-হু ‘আনহু ওয়ারাদূ 'আনহু ওয়া আ'আদ্দালাহুম জ্বান্না-তিন তাজরী তাহতাহাল আনহা-রু খা-লিদীনা ফীহাআবাদান যা-লিকাল ফাওঝুল ‘আজীম।" অর্থাৎ— "আর যেসব মুহাজির ও আনসার (ঈমান আনয়নে) অগ্রবর্তী এবং প্রথম, আর যেসব লোক সরল অন্তরে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁতে সন্তুষ্ট আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত; যার মধ্যে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; এটা মহাসাফল্য।"
এই আয়াতে তিন শ্রেণীর লোকের বর্ণনা বিদ্যমান; প্রথমতঃ মুহাজিরগণ, যাঁরা দ্বীনের খাতিরে আল্লাহ ও রসূলের আদেশ পালনার্থে মক্কা ও অন্যান্য এলাকা থেকে হিজরত করতঃ সকল কিছু ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান। দ্বিতীয়তঃ আনসারগণ, এঁরা মদীনার অধিবাসী ছিলেন; এঁরা সর্বাবস্থায় রসূল (সাঃ)-এর সাহায্য ও সুরক্ষা বিধান করেছিলেন এবং মদীনায় আগত মুহাজিরদের যথাযথ সম্মান করেছিলেন এবং নিজেদের সবকিছু তাদের খিদমতে কুরবান করে দিয়েছিলেন। এখানে সেই উভয় শ্রেণীর 'ওয়াস-সাবিক্বূনাল আওয়ালূন' (অগ্রবর্তী ও প্রথম) ব্যক্তিবর্গের কথা বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ— সেই উভয় শ্রেণীর মধ্যে ঐ সকল ব্যক্তি যাঁরা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।
ওঁনারা কারা ছিলেন, তা নির্ধারণ করণে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকের নিকট 'ওয়াস-সাবিক্বূনাল আওয়ালূন' তাঁরা, যাঁরা উভয় ক্বিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়েছেন। অর্থাৎ— ক্বিবলা পরিবর্তন হওয়ার পূর্বে যে সমস্ত মুহাজির ও আনসারগণ মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা। আবার অনেকের নিকট 'ওয়াস-সাবিক্বূনাল আওয়ালূন' ঐ সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম, যাঁরা হুদাইবিয়ায় অনুষ্ঠিত বাইআতে-রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আবার অনেকের নিকট ওঁরা হলেন তাঁরা, যাঁরা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইমাম শওকানী (রহঃ) বলেন, সকল অভিমতই সঠিক হতে পারে। তৃতীয়তঃ ঐ সকল ব্যক্তি, যাঁরা একনিষ্ঠভাবে সেই মুহাজির ও আনস্বারদের অনুগামী ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তাঁরা হলেন পারিভাষিক অর্থে তাবেয়ীগণ, যাঁরা নবী কারীম (সাঃ)-এর দর্শন লাভ করতে পারেননি, কিন্তু সাহাবায়ে কিরামগণের সাথী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আবার কেউ কেউ তা সাধারণ রেখেছেন, অর্থাৎ— কিয়ামত পর্যন্ত যে সকল মুসলিম মুহাজির ও আনসারগণের সাথে মহব্বত রাখবেন ও তাঁদের আদর্শের উপর চলবেন, তাঁরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; এতে পারিভাষিক অর্থে তাবেয়ীগণও এসে যাচ্ছেন।
'আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট' বাক্যটির অর্থ হলো, আল্লাহ তা'আলা তাঁদের সৎকর্ম গ্রহণ করেছেন, মানুষ হিসাবে তাঁদের কৃত ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তিনি তাঁদের উপর অসন্তুষ্ট নন। যদি তা না হত, তাহলে উক্ত আয়াতে তাঁদের জন্য জান্নাত ও জান্নাতের নিয়ামতের সুসংবাদ দেওয়া হল কেন? এই আয়াত দ্বারা এটাও জানা গেল যে, আল্লাহর এই সন্তুষ্টি সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং চিরস্থায়ী। যদি রসূলপাক (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর সাহাবায়ে কিরামগণের মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত (যেমন এক বাতিল ফির্কার বিশ্বাস আছে), তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন না। এ থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, যখন আল্লাহ তাআলা তাঁদের সমস্ত ত্রুটি মার্জনা করে দিয়েছেন, তখন তাঁদের সমালোচনা করে তাঁদের ভুল-ত্রুটি বর্ণনা করা কোন মুসলিমের উচিত নয়। বস্তুতঃ এটাও জানা গেল যে, তাঁদের প্রতি মহব্বত রাখা এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা'র সন্তুষ্টি অর্জনের কারণ। আর তাঁদের প্রতি শত্রুতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করা আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা'র সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ।
উক্ত তিন শ্রেণীর ছাড়াও ইসলাম গ্রহণকারী আরেকটি দল আছে, যারা সুবিধা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বা ঠেলায় পড়ে মুসলমান হয়েছিল; ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকে বলে 'তোলাকা'। মক্কা বিজয়ের দিন যারা খানায়ে কাবায় বা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদের বেশিরভাগই তোলাকা; আবু সুফিয়ানের ইসলাম কবুল করার ঘটনা দিয়েই তা অনুধাবন করা যায়। যেমন—
আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস ইসলাম প্রতিষ্ঠার অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইসলামের চরম শত্রু ছিলেন, মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সহীহ বর্ণনায় এসেছে— মক্কা বিজয়ের আগের রাতে ভীত ও শংকিত কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান, হাকীম বিন হেযাম ও বনু খোযা‘আহ নেতা বুদাইল বিন ওয়ারক্বা মুসলমানদের খবর জানার জন্য রাত্রিতে ময়দানে বের হয়ে এসেছিলেন। তারা হঠাৎ গভীর রাতে দিগন্তব্যাপী আগুনের শিখা দেখে হতচকিত হয়ে পড়েন ও একে অপরে নানারূপ আশংকার কথা বলাবলি করতে থাকেন। এমন সময় হযরত আববাস (রাঃ) তাদের কণ্ঠস্বর চিনতে পারেন ও কাছে এসে বলেন, কি দেখছ, এগুলি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সেনাবাহিনীর জ্বালানো আগুন। একথা শুনে ভীত কম্পিত আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন- এখন বাঁচার উপায় কি? আববাস (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমাকে পেয়ে গেলে তিনি অবশ্যই তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবেন’। অতএব এখুনি আমার খচ্চরের পিছনে উঠে বস এবং চলো রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে আমি তোমার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করে আবু সুফিয়ান খচ্চরের পিছনে উঠে বসলেন এবং তার সাথী দু’জন ফিরে গেলেন।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তাঁবুতে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সকলে রাসূল (সাঃ)-এর সাদা খচ্চর ও তাঁর চাচা আববাসকে দেখে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিয়েছে। ওমরের নিকটে পৌঁছলে তিনি উঠে কাছে এলেন এবং পিছনে আবু সুফিয়ানকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘আবু সুফিয়ান, আল্লাহর দুশমন! আলহামদুলিল্লাহ কোনরূপ চুক্তি ও অঙ্গীকার ছাড়াই আল্লাহ তোমাকে আমাদের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছেন’। বলেই তিনি রাসূল (সাঃ )-এর তাঁবুর দিকে চললেন। আববাস (রাঃ) বলেন, আমিও দ্রুত খচ্চর হাঁকিয়ে দিলাম এবং তার আগেই রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে গেলাম। অতঃপর তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। ইতিমধ্যে ওমর এসে পৌঁছলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই সেই আবু সুফিয়ান! আমাকে হুকুম দিন ওর গর্দান উড়িয়ে দেই’। আববাস (রাঃ) তখন রাসূল (সাঃ )-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি’। অতঃপর আমি রাসূল (সাঃ )-এর কাছে উঠে গিয়ে কানে কানে বললাম, ‘আল্লাহর কসম! আমি ছাড়া অন্য কেউ আজ রাতে আপনার সাথে গোপনে কথা বলবে না’। এরপর ওমর ও আববাসের মধ্যে কিছু বাক্য বিনিময় হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে আববাস! এঁকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে যান। সকালে ওঁকে নিয়ে আমার কাছে আসুন’।
সকালে তাঁর নিকটে গেলে তিনি আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘তোমার জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, একথা উপলব্ধি করার সময় কি তোমার এখনো আসেনি’? আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হউন! আপনি কতইনা সহনশীল, কতই না সম্মানিত ও কতই না আত্মীয়তা রক্ষাকারী। আমি বুঝতে পেরেছি যে, যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য থাকত, তাহ’লে এতদিন তা আমার কিছু কাজে আসত’। তখন রাসূল (সাঃ ) বললেন, 'তোমার জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আমি যে আল্লাহর রাসূল একথা উপলব্ধি করার সময় কি তোমার এখনো আসেনি’? আবু সুফিয়ান বললেন, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন! আপনি কতই না সহনশীল, কতই না সম্মানিত এবং কতই না আত্মীয়তা রক্ষাকারী, ‘কেবল এই ব্যাপারটিতে আমার মনের মধ্যে এখনো কিছুটা সংশয় রয়েছে’। সঙ্গে সঙ্গে ধমকের সুরে আববাস (রাঃ) তাকে বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হৌক! গর্দান যাওয়ার পূর্বে ইসলাম কবুল কর এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’। সঙ্গে সঙ্গে আবু সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের মাধ্যমে ইসলাম কবুল করলেন।
অতঃপর হযরত আববাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ‘আবু সুফিয়ান গৌরব প্রিয় মানুষ। অতএব এ ব্যাপারে তাকে কিছু প্রদান করুন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) বললেন, 'বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে দিবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’। —(ইবনু হিশাম : ২/৪০৩; মুসলিম : হাদীস-১৭৮০; আবুদাঊদ : হাদীস-৩০২১; মিশকাত : হাদীস-৬২১০।)
সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রমাণিত এবং এই কথাটি প্রায় সবার কাছে প্রকাশিত যে, মানবসৃষ্ট রাষ্ট্রনীতি রাজতন্ত্র এবং রাজার রাজনীতি খুবই খতরনাক ব্যাপারস্যাপার; কিন্তু আল্লাহর খেলাফত সম্পূর্ণ আলাদা বরকতময় একটি জিনিস। 'খেলাফত' শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রতিনিধিত্ব করা, অন্য কারো স্থানে স্থলাভিষিক্ত হওয়া। আর 'খলিফা' শব্দের অর্থ প্রতিনিধি, স্থলাভিষিক্ত; 'খলিফা' শব্দের বহুবচন 'খুলাফা' এবং 'খালাইফ'। ইসলামে 'খেলাফত' এমন একটি শাসন ব্যবস্থার নাম যা মহান আল্লাহর বিধান ও মহানবী (সাঃ)-এর সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত। এই শাসন ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা। তিনিই বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং সর্বোচ্চ শাসক। মানুষের মর্যাদা হলো, সে সর্বোচ্চ শাসকের প্রতিনিধি বা খলিফা এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে সর্বোচ্চ শাসকের বিধানের অধীন। খলিফার কাজ হলো, সর্বোচ্চ শাসক আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা'র আইনকে তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যকর করা এবং তাঁর নির্দেশিত পথে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা।
খেলাফত সম্পর্কে খুলাফায়ে রাশেদিন এবং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাহাবিদের সর্বসম্মত অভিমত ছিল— খেলাফত একটি নির্বাচনভিত্তিক পদমর্যাদা; মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শ এবং তাঁদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমেই তা কায়েম করতে হবে। বংশানুক্রমিকভাবে বা বল প্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া কিংবা নেতৃত্ব দেয়া তাদের মতে খেলাফত নয়, বরং তা রাজতন্ত্র। খেলাফত ও রাজতন্ত্রের যে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা সাহাবি (রা:)-গণ পোষণ করতেন, হজরত আবু মুসা আল-আশ‘আরি (রাঃ) তা ব্যক্ত করেছেন এভাবে— 'খেলাফত হচ্ছে তাই, যা প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ নেয়া হয়েছে; আর তরবারির জোরে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাদশাহী বা রাজতন্ত্র।'
ইসলামের এই খেলাফত ব্যবস্থা সর্বজনীন। আল্লাহর এই প্রতিনিধিত্বের অধিকার বিশেষ কোনো ব্যক্তি, পরিবার কিংবা বিশেষ কোনো শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট বা সংরক্ষিত নয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী এবং তাঁদের বিধান ও আইন মান্যকারী সব মানুষই আল্লাহর দেয়া এই প্রতিনিধিত্বের সমান অধিকারী। এ প্রসঙ্গে কুর'আনুল কারীমায় বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল আল্লাহ তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন।’ —(সূরা আন নূর : ৫৫)।
ইসলামে নবুওয়াতের পদমর্যাদার পর এই খেলাফত ব্যবস্থাই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন এবং এ পদটি পবিত্র দায়িত্বপূর্ণ পদ। বস্তুত ইসলামে খেলাফতের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সর্বাত্মক। যাবতীয় বৈষয়িক, ধর্মীয় ও তমদ্দুনিক উদ্দেশ্যের পূর্ণতা বিধান এরই ভিত্তিতে হয়ে থাকে। রাসূলের কার্যাবলিকে চালু ও প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং যেকোনো প্রকার মিশ্রণ বা ভেজাল থেকে তা সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধন করা খেলাফতের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
হজরত আলি (রাঃ) বলেন, "মহানবী (সাঃ) বলেছেন, হজরত আবু বকর (রাঃ) এবং হজরত উমর (রাঃ) নবী-রাসূলগণ ব্যতীত পৃথিবীর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত জান্নাতবাসী বয়স্ক লোকদের নেতা হবেন।" —(জামে তিরমিজি)।
হজরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন, "রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলি (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেছেন, হজরত মুসা (আঃ)-এর কাছে হজরত হারুন (আঃ)-এর যে মর্যাদা ছিল, তুমিও আমার কাছে সেই মর্যাদায় অভিষিক্ত। তবে আমার পরে কোনো নবী নেই।" — (সহিহ বুখারি)।
খোলাফায়ে রাশেদার ৩০ বছর শাসনকাল ৬৩২ খ্রি. থেকে ৬৬১ খ্রি. পর্যন্ত পর্যালোচনা করলে একজন খলিফার যে বৈশিষ্ট্যগুলো জানা যায় তা সমগ্র মানবজাতিকে বিমোহিত করে—
১) খুলাফায়ে রাশেদিনের আমল হুজুরপাক (সাঃ)-এর পবিত্র জীবনাদর্শ উজ্জ্বল প্রদীপে পরিণত হয়েছিল এবং তা সমগ্র পরিমণ্ডলকে নির্মল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করে রেখেছিল। খলিফাগণের প্রতিটি কাজে ও চিন্তায় তার গভীর প্রভাব বিদ্যমান। হযরত হাসান (রাঃ)-সহ পূর্ববর্তী চারজন খলিফাই হুজুরপাক (সাঃ)-এর একান্ত প্রিয়পাত্র ও বিশিষ্ট সাহাবি ছিলেন। তাঁরা ছিলেন তাঁর সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত এবং তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত প্রাণ। হজরত আলি (রাঃ) ও হাসান (রাঃ) ব্যতীত অন্য তিনজন খলিফা মহানবী (সাঃ)-এর দ্বিতীয় কর্মকেন্দ্র ও শেষ শয্যাস্থল মদিনায় রাজধানী রেখেই খিলাফতের প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিলেন।
২) তাঁরা ছিলেন মুসলিম উম্মাহর সর্বাপেক্ষা অধিক আস্থাভাজন। আধুনিক কালের পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন হলেও তখন কেবল তাঁরাই যে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
৩) খেলাফতে রাশেদার আমলে আইন প্রণয়নের ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ। যে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশ পাওয়া যেত না, সে বিষয়ে ইজতিহাদ করে সুষ্ঠু সমাধান বের করার চেষ্টা করা হতো এবং এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহয় পারদর্শী প্রত্যেক নাগরিকেরই মতামত দেয়ার সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল।
৪) খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে রাজকীয় ভোগবিলাস, জাঁকজমক ও শান-শওকতের কোনো স্থান ছিল না। খলিফাগণ একান্তই সাধারণ নাগরিকদের ন্যায় জীবনযাপন করতেন। তাঁদের কোনো দেহরক্ষী ছিল না। লোকজন যখন ইচ্ছা খলিফার নিকট উপস্থিত হতে পারতেন।
৫) খুলাফায়ে রাশেদিন বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রের সরকারি কোষাগারকে জাতীয় সম্পদ ও আমানতের ধন মনে করতেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মঞ্জুরি ব্যতীত নিজের জন্য একটি কপর্দকও কেউ ব্যয় করতেন না।
৬) তাঁরা নিজেদেরকে জনগণের খাদেম মনে করতেন। কোনো ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেদেরকে জনসাধারণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধারণা পোষণ করতেন না। তাঁরা কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই জননেতা ছিলেন না, নামাজ ও হজ্জ প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যাপারেও যথারীতি তাঁরাই নেতৃত্ব দিতেন।
খেলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য এবং মূলনীতিগুলো এতোক্ষণ পর্যালোচনা করা হলো। বস্তুত খেলাফতে রাশেদা কেবল একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই ছিল না, বরং তা ছিল নবুয়াতের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল একটি ব্যবস্থা অর্থাৎ দেশের শাসন-শৃংখলা বজায় রাখা, শান্তি স্থাপন ও সীমান্ত রক্ষা করাই কেবল তাঁর দায়িত্ব না; বরং তাঁরা মুসলমানদের সামাজিক জীবনে শিক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক এবং পথ-প্রদর্শকের এমন সব দায়িত্ব পালন করতেন, যা নবী কারীম (সাঃ) তাঁর জীবনে পালন করেছেন। দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্রে সত্য-সনাতন দ্বীনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থাকে তার সত্যিকার আকার-আঙ্গিক এবং প্রাণ-ধারায় সঞ্জীবিত করে পরিচালনা করা এবং বিশ্বে মুসলমানদের গোটা সামাজিক শক্তি নিচয়কে আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার কাজে নিয়োজিত করাই ছিল তাঁদের দায়িত্ব। এ কারণে তাঁদেরকে কেবল খেলাফতে রাশেদা না বলে বরং এ সঙ্গে খেলাফতে মুরশেদা, সত্য-পথ প্রদর্শক খেলাফত বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়াত, নবুয়াতের পদাংক অনুসারী খেলাফত কথাটিতে এ উভয় বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এ ধরনের রাষ্ট্রই ইসলামের অভিপ্রেত, নিছক রাজনৈতিক শাসন-কতৃত্ব নয়, দ্বীনের সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন কোন ব্যক্তিই এ সম্পর্কে অনবহিত থাকতে পারে না।
যে সকল পর্যায় অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত এ খেলাফত রাজতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করেছে, এখানে আমরা সেগুলো পর্যালোচনা করবো। এ পরিবর্তন মুসলমানদের রাষ্ট্রকে ইসলামের শাসননীতি থেকে কতটা দূরে সরিয়ে নিয়েছে, মুসলমানদের সমাজ জীবনে তার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তাও আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
পরিবর্তনের সূচনা—
হযরত ওমর (রাঃ) যেখান থেকে এ পরিবর্তনের আশংকা করেছিলেন, ঠিক সেখান থেকেই এ পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। ওফাতের নিকটবর্তী সময়ে যে বিষয়ে তিনি সবচেয়ে বেশী অশংকা করতেন, তা ছিল এই যে, তাঁর স্থলাভিষিক্তরা যেন তাদের বংশ, গোত্র এবং নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময় থেকে তাঁর (হযরত ওমর) শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত নীতির পরিবর্তন না করে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর গোটা শাসনামলে হযরত আলি (রাঃ) ব্যতীত বনী হাশেমের অপর কোন ব্যক্তিকে কোন পদ দান করেননি। হযরত আলি (রাঃ) তাঁর খেলাফত কালে নিজের বংশ-গোত্র থেকে কাউকে কোন পদ দান করেননি। হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর দশ বৎসরের শাসনামলে বনী আদীর কেবলমাত্র একজন লোককে একটি ক্ষুদ্র পদে নিযুক্ত করেন এবং অবিলম্বেই তাকে সে পদ থেকে বরখাস্ত করেন; এ কারণে সে সময় গোত্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। হযরত ওমর (রাঃ)-এর আশংকা ছিল, এ নীতি পরিবর্তিত হলে তা মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হবে। তাই তিনি তাঁর তিনজন সম্ভাব্য উত্তরসূরী— হযরত ওসমান, হযরত আলী এবং হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে পৃথক পৃথকভাবে ডেকে ওসিয়াত করেন, "আমার পরে তোমরা খলীফা হলে তোমাদের গোত্রের লোকদেরকে মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে না।" —[‘তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৬৪; তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪০, ৩৪১, ৩৪৩, ৩৪৪।]
কিন্তু তাঁর পরে হযরত ওসমান (রাঃ) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ধীরে ধীরে এ নীতি থেকে দূরে সরে যান। তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে একের পর এক বিরাট বিরাট সব পদ দান করতে থাকেন। তিনি তাদেরকে এমনসব সুযোগ-সুবিধা দান করেন, যা জনগণের মধ্যে সাধারণভাবে সমালোচনার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়। উদাহরণ স্বরূপ— তিনি আফ্রিকার গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশের সম্পূর্ণ অংশই (৫ লক্ষ দীনার) মারওয়ানকে দান করেন। এ ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর গবেষণা বিবৃত করেছেন এ ভাবে— আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবিসারাহ আফ্রিকার গনিমাতের মালের এক-পঞ্চমাংশ মদীনায় নিয়ে আসেন এবং মারওয়ান ইবনুল হাকাম ৫ লক্ষ দীনার দিয়ে তা খরদী করেন। অতঃপর হযরত ওসমান (রাঃ) তার নিকট থেকে এ মূল্য গ্রহণ করেননি। যেসব কারণে হযরত ওসমান (রাঃ)-র সমালোচনা করা হয়, এটা ছিল তার অন্যতম। আফ্রিকার মালে গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ সম্পর্কে যতো বর্ণনা পাওয়া যায় এ বর্ণনা তন্মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ।
কেউ কেউ বলেন, হযরত ওসমান (রাঃ) আফ্রিকার গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ আবদুল্লাহ ইবনে সা’আদকে দান করেন; আবার কেউ কেউ বলেন, মারওয়ান ইবনে হাকামকে দান করেন। এ বর্ণনা থেকে এ তত্ত্ব জানা যায় যে, হযরত ওসমান (রাঃ) আফ্রিকার প্রথম যুদ্ধের গনীমাতের মালের এক-পঞ্চমাংশ আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দকে দান করেন, আর দ্বিতীয় যুদ্ধ— যাতে আফ্রিকার গোটা এলাকা বিজিত হয় তার গনীমাতের মালের এক-পঞ্চমাংশ মারওয়ানকে দান করেন। —(আল-কামেল ফিত তারীখ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬, মাতবাআতুত তিবআতীল মুনীরিয়্যাহ, মিসর ১৩৪৮ হিজরী।) ইবনে সা’আদও তাবাকাত-এ ইমাম যুহরীর সনদে বর্ণনা করেন— হযরত ওসমান (রাঃ) মিসরের গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ মারওয়ানকে লিখে দিয়েছেন —(৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬৪)। ইমাম যুহরীর এ বর্ণনা সম্পর্কে আপত্তি করা চলে যে, ইবনে সা’আদ এ বর্ণনাটি ওয়াকেদীর উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেছেন; আর ওয়াকেদী বিশ্বাসভাজন বর্ণনাকারী নয়।
প্রথমতঃ সকল মুহাদ্দিদসই ইবনে সা'আদকে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসভাজন বলে স্বীকার করেন। তাঁর সম্পর্কে স্বীকার করা হয় যে, তিনি যাচাই-বাছাই করে রেওয়ায়াত গ্রহণ করতেন। এ কারণে তাঁর কিতাব তাবাকাত ইসলামের ইতিহাসের একান্ত নির্ভরযোগ্য উৎস বলে স্বীকৃত। দ্বিতীয়তঃ স্বয়ং ওয়াকেদী সম্পর্কেও জ্ঞানীরা এ কথা জানেন যে, আহকাম এবং সুনান সম্পর্কে তাঁর হাদীসকে রদ করা হয়েছে। বাকি থাকে ইতিহাস এবং বিশেষ করে মাগাযী এবং সিয়ার অধ্যায়। এ ব্যাপারে কে ওয়াকেদীর বর্ণনা গ্রহণ করেননি। ইতিহাসের ব্যাপারে কোন ব্যক্তি যদি বর্ণনার প্রমাণের জন্য হুবুহু এমনসব শর্ত আরোপ করে শরীয়তের বিধানের ক্ষেত্রে মুদহাদ্দিদসগণ যা আরোপ করেছেন, তাহলে ইসলামের ইতিহাসের শতকরা ৯০ ভাগ বরং তার চেয়েও বেশী অংশকে বাদ দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইবনে খালদুন সহ কেউ কেউ যাঁকে অন্যদের চেয়ে বেশী বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন, তিনি ইবনে আসীর এবং ইবনে সা’দের এ বর্ণনা সমর্থন করেছেন; দ্রষ্টব্য দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট পৃষ্ঠা- ১৩৯-১৪০।
হযরত ওসমান (রাঃ) হযরত সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে পদচ্যুত করে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই ওয়ালীদ ইবনে উকবা ইবনে আবী মোয়াইতকে কুফার গবর্ণর নিযুক্ত করেন। এরপরে তাঁর অপর এক বন্ধু সাঈদ ইবনে আ’সকে এ পদ দান করেন। হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-কে বসরার গবর্ণরের পদ থেকে বরখাস্ত করে তাঁর মামাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আমেরকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করেন। হযরত আমর ইবনুল আসকে মিসরের গভর্ণরী থেকে সরিয়ে নিজের দুধভাই আবদুল্লাহ ইবনে সা’আদ ইবনে আবিসারাহকে নিযুক্ত করেন। সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-এর জামানায় হযরত মুআবিয়া (রাঃ) কেবল সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। হাফেয ইবনে কাসীর বলেন— 'সত্য কথা এই যে, হযরত ওসমান (রাঃ) সিরিয়ার গোটা এলাকা হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-র গভর্ণরীতে সংযোজন করেন। হযরত ওমর (রাঃ) তাঁকে কেবল সিরিয়ার অংশবিশেষের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।’ —(আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৪।) হযরত ওসমান (রাঃ) দামেস্ক, হেমছ, ফিলিস্তিন, জর্দান এবং লেবাননের গোটা এলাকা তাঁর শাসনাধীন করে দেন।
অতঃপর তাঁর চাচাতো ভাই মারওয়ান ইবনুল হাকামকে তিনি তাঁর সেক্রেটারী নিযুক্ত করেন, যার ফলে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিপত্তি পড়ে। এমনি করে একই বংশের হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।
কেবল সাধারণ লোকদের উপরই নয়, বড় বড় সাহাবীদের উপরও এসব বিষয়ের প্রতিক্রিয়া খুব একটা শুভ হয়নি, হতেও পারে না। উদাহরণস্বরুপ— ওয়ালীদ ইবনে ওকবা কুফার গভর্ণরীর পরওয়ানা নিয়ে হযরত সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-র নিকট উপস্থিত হলে তিনি বলেন, ‘জানি না, আমার পরে তুমি বেশী জ্ঞানী হয়ে গেছো, না আমি বোকা হয়ে গেছি।’ তিনি জবাব দেন, 'আবু ইসহাক! ক্রুদ্ধ হয়ো না, এটাতো বাদশাহী। সকালে একজন এ নিয়ে মৌজ করে, সন্ধ্যায় আরেক জন।’ হযরত সা’আদ (রাঃ) বলেন, 'বুঝতে পেরেছি, সত্যিই তোমরা একে বাদশাহী বানিয়ে ছাড়বে।’ প্রায় এহেন মনোভাব হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-ও ব্যক্ত করেন। —(ইবনে আবদুল বার আল-এস্তীআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬০৪।)
এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, হযরত ওসমান (রাঃ) নিজের বংশের যেসব ব্যক্তিদেরকে এসব সরকারী পদ দান করেন, তাঁরা নিজেদের উন্নত পর্যায়ের প্রশাসনিক এবং সামরিক দক্ষতা প্রমাণ করেছেন তাঁদের হাতে বহু ভূখন্ড বিজিত হয়েছে; কিন্তু এ কথা সুস্পষ্ট যে, যোগ্যতা কেবল এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উৎকৃষ্ট যোগ্যতার অধিকারী আরও অনেকেই বর্তমান ছিলেন; তাঁরা ইতিপূর্বে এদের চেয়েও উত্তম খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন। খোরাসান থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত গোটা এলাকা একই বংশের গভর্ণরদের অধীনে আনা এবং কেন্দ্রীয় সেক্রেটারীয়েটেও একই বংশেরই লোক নিয়োগ করার জন্য নিছক যোগ্যতাই একমাত্র ভিত্তি হতে পারে না। রাষ্ট্রপ্রধান যে বংশের হবেন, রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে সে বংশের লোকদের নিয়োগ করা প্রথমতঃ এমনিতেই আপত্তিকর। কিন্তু এ ছাড়াও আরো এমন কিছু কার্যকরণ ছিল, যার ফলে পরিস্থিতিতে আরও জটিলতা দেখা দেয়।
প্রথমতঃ উমাইয়া খান্দানের যেসব লোক হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সময়ে অগ্রসর হয়েছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন তোলাকা। তোলাকা মানে হচ্ছে মক্কার এমন এক বংশ, যারা শেষ পর্যন্ত নবী (সঃ) এবং ইসলামী দাওয়াতের বিরোধী ছিল। মক্কা বিজয়ের পর হুজুরপাক (সঃ) তাদেরকে ক্ষমা করেন এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) ওয়ালীদ ইবনে ওকবা (রাঃ) এবং মারওয়ান ইবনুল হাকাম এ ক্ষমাপ্রাপ্ত সেই বংশের লোকজন ছিলেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে সা'আদ ইবনে আবি সারাহ তো মুসলমান হওয়ার পরে মুর্তাদ হয়ে যান। মক্কা বিজয়ের পর যেসব ব্যক্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সঃ) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এরা খানায়ে কাবার গিলাফ জড়িয়ে ধরে থাকলেও এদেরকে হত্যা করে দাও, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। হযরত ওসমান (রাঃ) তাকে নিয়ে হঠাৎ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সামনে উপস্থিত হন এবং তিনি নিছক হযরত ওসমানের মর্যাদার খাতিরে তাকে ক্ষমা করে দেন। প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম সারির মুসলমানগণ, ইসলামের বিজয়ের জন্য যাঁরা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, যাঁদের ত্যাগ-কুরবানীর ফলে আল্লাহ-র দ্বীন বিজয়ী হয়েছে, তাঁদেরকে পেছনে সরিয়ে দিয়ে এরা উম্মাতের নেতা হবে— স্বভাবত এটা কেউ পছন্দ করতে পারেননি।
দ্বিতীয়তঃ ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য এরা উপযুক্তও ছিলেন না; কারণ, তারা ঈমান অবশ্য এনেছিলেন, কিন্তু নবী করীম (সাঃ)-এর সান্নিধ্যে প্রশিক্ষণ দ্বারা এতটুকু উপকৃত হওয়ার তাদের সুযোগ হয়নি, যাতে তাদের মন-মানসিকতা এবং নীতি-নৈতিকতার আমুল পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। তারা উৎকৃষ্ট ব্যবস্থাপক, প্রশাসক এবং বিজেতা হতে পারেন; বাস্তবে তারা তাই প্রমাণিত হয়েছেন, কিন্তু ইসলাম তো নিছক রাজ্য জয় আর দেশ শাসনের জন্য আসেনি। ইসলাম প্রথম এবং মূলতঃ মঙ্গল-কল্যাণের একটি ব্যাপক আহ্বান বিশেষ। এর নেতৃত্বের জন্য প্রশাসনিক এবং সামরিক যোগ্যতার চেয়ে মানসিক এবং নৈতিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বেশী দরকার। আর এ বিবেচনায় এদের স্থান ছিল সাহাবা-তাবেঈনদের প্রথম সারিতে নয়, বরং পেছনের সারিতে।
এ প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ মারওয়ান ইবনে হাকামের অবস্থাটাই লক্ষণীয়। তাঁর পিতা হাকাম ইবনে আবিল আস হযরত ওসমান (রাঃ)-এর চাচা ছিলেন। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হন এবং মদীনায় এসে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর কোন কোন আচরণের কারণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে মদীনা থেকে বের করে দেন এবং তায়েফে বসবাসের নির্দেশ দেন। ইবনে আবদুল বার তাঁর আল এস্তীআব-এ এর অন্যতম কারণ বর্ণনা করে বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বড় বড় সাহাবীদের সাথে একান্তে যেসব পরামর্শ করতেন, তিনি কোন না কোন প্রকারে তা সংগ্রহ করে ফাঁস করে দিতেন। দ্বিতীয় কারণ তিনি এই বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- এর ভান ধরতেন; এমনকি রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে এমনটি করতেও দেখে ফেলেন। —(আল-এস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১১৮-১১৯, ২৬৩)
যাই হোক, যেকোন মারাত্মক অপরাধের কারণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে মদীনা ত্যাগের নির্দেশ দেন; মারওয়ানের বয়স তখন ৭-৮ বছর। তিনিও পিতার সঙ্গে তায়েফে বসবাস করতে থাকেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) খলীফা হলে তাঁর কাছে তাঁকে ফিরিয়ে আনার অনুমতি চাওয়া হলে তিনি অস্বীকার করেন। হযরত ওমর (রাঃ) এর সময়েও তাঁকে ফিরিয়ে আনার অনুমতি চাওয়া হলে তিনিও অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। মারওয়ান বা হাকামকে মদীনায় আসার অনুমতি দেয়া হয়নি। হযরত ওসমান (রাঃ) তাঁর খেলাফতকালে তাঁকে ডেকে আনেন, এবং এক বর্ণনা অনুযায়ী তিনি এর কারণ এই বর্ণনা করেন যে, 'আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট তার জন্য সুপারিশ করেছিলাম, তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে, তাকে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেবেন।' এমনি করে পিতা-পুত্র উভয়ে তায়েফ থেকে মদীনা চলে আসেন। —(ইবনে হাজার; আল-এসাবা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪৪, ৩৪৫; আর রিয়াযুন নায়েরাহ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠ- ১৪৩।)
মারওয়ানের এ পটভূমির প্রতি লক্ষ্য করলে এ কথা ভালভাবেই হৃদয়ঙ্গম করা যায় যে, তাঁর সেক্রেটারী পদে নিয়োগকে লোকেরা কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি। হুজুরপাক (সাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ) এর সুপারিশ গ্রহণ করে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ওয়াদা করেছিলেন— জনগণ হযরত ওসমান (রাঃ)-র কথায় আস্থা স্থাপন করে এটা মেনে নিয়েছিলেন। তাই তাকে মদীনায় ডেকে আনাকে তাঁরা আপত্তিকর মনে করেননি। কিন্তু বড় বড় সাহাবীকে বাদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিরাগভাজন ব্যক্তির পুত্রটিকেই সেক্রেটারী করার ব্যাপারটি মেনে নেয়া তাদের জন্য বড়ই কঠিন হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে তার বিরাগভাজন পিতা তখন জীবিত এবং পুত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কার্যে তার প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল। প্রকাশ থাকে যে, হাকাম হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শেষ সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন; হিজরী ৩২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তৃতীয়তঃ তাদের কারো চরিত্র এমন ছিল যে, সে সময়ের পবিত্রতর ইসলাম সমাজে তাদের মতো লোকদেরকে উচ্চপদে নিয়োগ করা কোন শুভ প্রভাব প্রতিফলিত করতে পারতো না। উদাহরণস্বরূপ— ওয়ালীদ ইবনে ওকবার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে; ইনিও ছিলেন মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বনীল মুস্তালিকের সদকা উসুল করার জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি তাদের এলাকায় পৌঁছে কোন কারণে ভীত হয়ে ফিরে আসেন। তাদের সাথে সাক্ষাৎ না করেই তিনি মদীনায় ফিরে এসে উল্টো রিপোর্ট দেন যে, 'বনীল মুস্তালিক যাকাত দানে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে।' এতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের বিরুদ্ধে এক সামরিক বাহিনী প্রেরণ করেন। এক বিরাট অঘটন ঘটার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কবীলার সর্দাররা এ সম্পর্কে যথাসময়ে অবহিত হন। তাঁরা মদীনায় হাজির হয়ে আরজ করেন, 'ইনি তো আমাদের নিকটই আসেননি। আমরা প্রতীক্ষা করছিলাম, কেউ আমাদের নিকট এসে যাকাত উসুল করে নিয়ে যাবে।'
এ উপলক্ষে কুর'আনের নিন্মোক্ত আয়াতটি নাযিল হয় — "ঈমানদাররা! কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের কাছে এসে কোন খবর দিলে তোমরা অনুসন্ধান করো। তোমরা অজানা অবস্থায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং পরে নিজেদের কর্মকান্ডের জন্য অনুতাপ করবে- এমন যেন না হয়।" —(আল হুজুরাত-৬)
তাফসীরকারকগণ সাধারণত উপরোক্ত ঘটনাকেই এ আয়াতের শানে নুযুল হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তাফসীরে ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য— ইবনে আবদুল বার বলেন, আয়াতটি ওয়ালীদ ইবনে ওকবা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে; এ ব্যাপারে জ্ঞানীদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। ইবনে তাইমিয়াও স্বীকার করেন যে, এ আয়াত ওয়ালীদ ইবনে ওকবা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। —(মিনহাজুস সুননাতিন নববীয়্যাহ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা – ১৭৬ আমীরিয়্যা প্রেস, মিসর ১৩২২ হিজরী)।)
এ ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর ওমর (রাঃ) তাঁকে পুনরায় খেদমতের সুযোগ দান করেন। হযরত ওমর (রাঃ) এর শেষ সময়ে তাকে আল-জাসীয়ারা আরব এলাকায়— যেখনে বনী তগলব বাস করতো, তাকে সেখানকার আমেল (কালেক্টর) নিযুক্ত করা হয়। —[তাহযিবুত তাহযীব, ১১শ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৪; ওমদাতুল কারী, ১৬শ খণ্ড, পৃষ্ঠ- ২০৩; ইদারাতুত তিবাআতিল মুনীরিয়্যাহ, মিসর।]
২৫ হিজরীতে এ ক্ষুদ্র পদ থেকে তুলে নিয়ে হযরত ওসমান (রাঃ) তাকে হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-র স্থলে কুফার মতো বিরাট এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের গভর্ণর নিযুক্ত করেন। সেখানে এ রহস্য ফাঁস হয়ে যায় যে, তিনি শরাব পানে অভ্যস্ত। এমন কি একদিন তিনি ফজরের সালাত ৩ রাকাত আদায় করান, অতঃপর মুসুল্লীদের প্রতি লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করেন, 'আরো আদায় করবো?' —[ আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৫; আল-ইস্তীআব, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৬০৪] ইবনে আবদুল বার বলেন যে, নেসাগ্রস্থ অবস্থায় ওয়ালীদের সালাত আদায় করানো, অতঃপর আরও আদায় করবো কি? জিজ্ঞেস করা প্রসিদ্ধ। নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীরা হাদীসবেত্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
এ ঘটনা সম্পর্কিত অভিযোগ মদীনায় পৌঁছে, এবং জনগণের মধ্যে এর ব্যাপক চর্চা হতে থাকে। অবশেষে হযরত মেসওয়ার ইবনে মাখরামা ও আবদুর রহমান ইবনে আসওয়াদ হযরত ওসমান (রাঃ) এর ভাগ্নে ওবায়দুল্লাহ ইবনে আদী ইবনে খেয়ারকে বলেন, 'তুমি গিয়ে তোমার মামার সাথে কথা বলো, তাঁকে বলো যে, তাঁর ভাই ওয়ালীদ ইবনে ওকবার ব্যাপারে লোকেরা তাঁর কার্যকলাপ সম্পর্কে অনেক আপত্তি তুলেছে।' তিনি এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন করে আরয করেন যে, ওয়ালীদের ওপর ’হুদ’ (শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী দণ্ড দান) জারী করা আপনার জন্য জরুরী। এ আবেদন জানালে হযরত ওসমান (রাঃ) ওয়াদা করেন যে, 'এ ব্যাপারে আমরা হক অনুযায়ী ফায়সালা করবো, ইনশাআল্লাহ।'
তদনুযায়ী সাহাবায়েকেরামের প্রাকশ্য সমাবেশে ওয়ালীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। হযরত ওসমান (রাঃ) এর নিজের আযাদকৃত দাস হুরমান সাক্ষ্য দেয় যে, ওয়ালীদ মদ্য পান করেছিলেন। অপর এক সাক্ষী সাব ইবনে জুসামা (বা জুসমা ইবনে সাব) সাক্ষ্য দেন যে, ওয়ালীদ তাঁর সামনে মদ-বমি করেছিল(ইবনে হাজারের বর্ণনা অনুযায়ী)। এ ছাড়াও আরও ৪ জন সাক্ষী-আবু যয়নাব, আবু তুআররা, জুন্দুর ইবনে যোহাইর আল-আযদী এবং সাদ ইবনে মালেক আল-আশআ’রীকে পেশ করা হয়। তারাও অপরাধের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তখন তার উপর ‘হদ’ জারীকরার জন্য হযরত ওসমান (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে নির্দেশ দেন।
হযরত আলী (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফরকে একাজে নিযুক্ত করেন এবং তিনি ওয়ালীদকে ৪০টি বেত্রঘাত করেন। বুখারী, কিতাবুল মানাকেব, বাবো মানাকেবে ওসমান ইবনে আফফান, ও বাবো হিজরাতিল হাবশা; মুসলিম, কিতাবুল হুদুদ বাবো হাদ্দিল খামর; আবুদাউদ, কিতাবুল হুদুদ, বাবো হাদ্দিল খামর। এসব হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ফকীহ ও মুহাদ্দেসগণ যা কিছু লিখেছেন, তা নিম্নরুপ—
হাফেজ ইবনে হাজার ফতহুলবারী গ্রন্থে লিখেছেন, লোকেরা যে কারণে ওয়ালীদের ব্যাপারে ব্যাপক আপত্তি করছিল, তা ছিল এই যে, হযরত ওসমান (রাঃ) তার ওপর ‘হদ’ কায়েম করছিলেন না। দ্বিতীয় কারণ এ ছিল যে, হযরত সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে পদচ্যুত করে তাঁর স্থলে ওয়ালীদকে নিয়োগ করা লোকেরা পছন্দ করতো না। কারণ, হযরত সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) ছিলেন আশারা-ই-মোবাশশারা এবং শুরার অন্যতম সদস্য। জ্ঞান-মাহাত্ম, দ্বীনদারী এবং প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণের এমন সব গুণাবলীর সমাবেশ তাঁর মধ্যে ঘটেছিল, যার কোন একটি গুণও ওয়ালীদ ইবনে ওকবার মধ্যে ছিল না……..
হযরত ওসমান (রাঃ) ওয়ালীদকে এ জন্য কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন যে, তাঁর নিকট তার যোগ্যতা প্রকাশ পেয়েছিল এবং তিনি আত্মীয়তার হকও আদায় করতে চেয়েছিলেন। অতঃপর তার চরিত্রের ত্রুটি তাঁর কাছে প্রকাশ পেলে তিনি তাকে পদচ্যুত করেন। তার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষী দিচ্ছিল, তাদের অবস্থা ভালভাবে জানার জন্য তিনি তার শাস্তি বিধানে বিলম্ব করেন। অতঃপর প্রকৃত পরিস্থিতি জানার পর তিনি তার ওপর ‘হদ’ জারী করার নির্দেশ দান করেন। —(ফতহুল বারী, কিতাবুল মানাকেব বাবো মানাকেবে ওসমান)।
অন্যত্র ইবনে হাজার লিখেন, মুসলিমের রেওয়াতের বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ আদ-দানাজ যইফ ছিলেন- এ কারণে তাহাবী মুসলিমের বর্ণনাকে দুর্বল প্রতিপন্ন করেছেন। কিন্তু বায়হাকী তাঁর এ মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে লিখেন যে, হাদীসটি সহীহ-বিশুদ্ধ; মাসানীদ এবং সুনান গ্রন্থে হাদীসটি গৃহীত হয়েছে। এ বর্ণনা সম্পর্কে তিরমিযী ইমাম বুখারীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে নির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেন; মুসলিমও তাকে সহীহ বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করেন। ইবনে আবদুল বার বলেন, এ হাদীস এ অধ্যায়ে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য……. আবুযুরআ’ এবং নাসায়ী আবদুল্লাহ আদ-দানাজকে বিশ্বস্ত-নির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। —(ফতহুল বারী, কিতাবুল হুদুদ, বাবুয যারবি বিল জারীদ ওয়ান নেয়াল)।
ইমাম নববী লিখেন, মুসলিমের এ হাদীস ইমাম মালেক এবং তাঁর সমমনা ফকীহদের এ মতের প্রমাণ যে, যে ব্যক্তি মদ-বমি করে, তার ওপর মদ পানের ‘হদ’ জারী করা হবে। ….... এ ব্যাপারে ইমাম মালেকের দলীল অত্যন্ত শক্তিশালী। সাহাবাগণ সর্ব সম্মতিক্রমে ওয়ালীদ ইবনে ওকবাকে বেত্রাঘাতের ফায়সালা করেছিলেন। —(মুসলিমের ভাষ্য, কিতাবুল হুদুদ বাবো হদ্দিল খামর)।
ইবনে কোদামা বলেন, মুসলিমের বর্ণনা অনুযায়ী, একজন সাক্ষী যখন এ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ওয়ালীদকে মদ-বমি করতে দেখেছেন, তখন হযরত ওসমান (রাঃ) বলেন, মদ পান না করে সে কি করে মদ-বমি করতে পারে। এ কারণে তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে তার ওপর হদ জারী করার নির্দেশ দেন। আর যেহেতু এ ফায়সালা হয়েছিল নেতৃস্থানীয়, জ্ঞানী ও আলেম সাহাবীদের উপস্থিতিতে, তাই এর ওপর ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। —(আল-মুগনী ওয়াশ শরহুল কবীর, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৩২, মানার প্রেস, মিসর, ১৩৪৮ হিজরী)
অতঃপর কেউ যদি বলে যে, যেসব ব্যক্তি ওয়ালীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করেছিলেন, তারা সকলেই ছিলেন বিশ্বাসের অযোগ্য, তাহলে সে ব্যক্তি কেবল হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে নয়, বরং সাহাবাদের বিরাট দলের বিরুদ্ধেই এই দেষারোপ করে যে, তাঁরা বিশ্বাসের অযোগ্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে একজন মুসলমানকে শাস্তি দান করেন।
এ ব্যাপারে জনৈক ব্যক্তি দাবী করে বসেছেন যে, হযরত হাসান (রাঃ) এ ফায়সালা সম্পর্কে নারাজ ছিলেন। কিন্তু ইমাম নববী মুসলিম এর ভাষ্যে এ হাদীসের যে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে এ মিথ্যার জারীজুরী ফাঁস হয়ে গিয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, হযরত হাসান (রাঃ) এর ক্রোধ ওয়ালীদের ওপর ছিল, তার বিরুদ্ধে ফায়সালাকারীদের প্রতি নয়।
এসব কারণে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নীতি লোকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। খলীফার আপন বংশের লোকদেরকে একের পর এক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা এমনিতেই ছিল যথেষ্ট আপত্তিকর কারণ। এর পরও তারা যখন দেখতে পেলো যে, এদেরকেই সামনে টেনে আনা হচ্ছে, তখন তাদের অস্থিরতা-অসন্তুষ্টি আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় এমন ছিল, যা সুদুরপ্রসারী এবং মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।
প্রথমটি হচ্ছে, হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত মুআবিয়া (রাঃ) কে ক্রমাগত দীর্ঘদিন ধরে একই প্রদেশের গবর্ণর পদে বহাল রাখেন। তিনি হযরত ওমর (রাঃ)- এর সময়ে ৪ বছর ধরে দামেশকের শাসনকর্তার পদে নিয়োজিত ছিলেন। হযরত ওসমান (রাঃ) আইলা থেকে রোম সীমান্ত পর্যন্ত এবং আল-জাযিরা থেকে উত্তর মহাসাগর পর্যন্ত গোটা এলাকা তার আওতাধীন করে গোটা শাসনকালে (১২ বছর) তাঁকে সে প্রদেশেই বহাল রাখেন। —[তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৪০৬, আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৫৩। বর্তমানে এ এলাকায় সিরিয়া, লেবানন, জর্দান এবং ইসরাইল ৪টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। এ ৪টি রাষ্ট্রের মোট আয়তন আজও প্রায় তাই, যা আমীর মুআ’বিয়ার গবর্ণর কালে ছিল। হযরত মুআ বিয়া, পৃষ্ঠা- ৩৪-৩৫ দ্রষ্টব্য)]
শেষ পর্যন্ত হযরত আলি (রাঃ)-কেও এর পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। এ শ্যাম প্রদেশটি তৎকালীন ইসলামী সাম্রাজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এলাকা ছিল। এর এক দিকে ছিল সকল প্রাচ্য প্রদেশ, আর অপর দিকে ছিল সকল পাশ্চাত্য প্রদেশ। মধ্যখানে এ দেশটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যে, এর শাসনকর্তা কেন্দ্র থেকে বিমুখ হলে প্রাচ্য প্রদেশসমূহকে পাশ্চাত্য প্রদেশগুলি থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারতেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এ প্রদেশের শাসনকার্যের দীর্ঘকাল নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সেখানে ভালভাবে আসন গেড়ে বসেছিলেন। তিনি কেন্দ্রের আওতায় ছিলেন না, বরং কেন্দ্র ছিল তাঁর দয়া-অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি এর চেয়েও মারাত্মক গোলযোগপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছিল, তা ছিল খলিফার সেক্রেটারীর গুরুত্বপূর্ণ পদে মারওয়ান ইবনুল হাকামের নিযুক্তি্। ইনি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কোমল প্রকৃতি এবং আস্থার সযোগে এমন অনেক কাজ করে বসেন, যার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত হযরত ওসমান (রাঃ) এর ওপর বর্তায়। অথচ এ সব কাজের জন্য তাঁর অনুমতি-অবগতির কোন তোয়াক্কাই করা হতো না। উপরন্ত তিনি হযরত ওসমান (রাঃ) এবং বড় বড় সাহাবীদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরাবার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালাতে থাকেন, যাতে খলিফা তাঁর পুরাতন বন্ধুদের স্থলে তাঁকে বেশী শুভাকাংখী এবং সমর্থক জ্ঞান করেন। —[তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৫ম খণ্ড, ৩৬ পৃষ্ঠা; আল-বেদায়া নেহায়া, ২৫৯ পৃষ্ঠা।]
কেবল তাই নয়, তিনি একাধিকার সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের সমাবেশে এমন সব হুমকিপূর্ণ ভাষণ দান করতেন, তোলাকাদের মুখ থেকে যা শুনে সহ্য করে যাওয়া প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের পক্ষে ছিল নিতান্ত কষ্টকর। এ কারণে অন্যরা তো দুরের কথা, হযরত ওসমান (রাঃ)-র স্ত্রী হযরত নায়লাও এ মত পোষণ করতেন যে, হযরত ওসমান (রাঃ) এর জন্য সংকট সৃষ্টির বিরাট দায়িত্ব মারওয়ানের ওপর বর্তায়, এমনকি একদা তিনি স্বামীকে স্পষ্ট বলে দেন, 'আপনি মারওয়ানের কথা মতো চললে সে আপনাকে হত্যা করিয়ে ছাড়বে। এ ব্যক্তিটির মনে আল্লার কোন মর্যাদা নেই, নেই কোন ভয়-ভীতি ও ভালবাসা।' —[তাবারী, ৩য় খণ্ড, ২৯৬-৯৭ পৃষ্ঠা, আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খণ্ড, ১৭২-১৭৩ পৃষ্ঠা।]
দ্বিতীয় পর্যায়—
হযরত ওসমান (রাঃ) এর নীতির এ দিকটি নিঃসন্দেহে ভুল ছিল; আর ভুল কাজ ভুলই, তা যে কেউ করুক না কেন। ভাষার মারপ্যাচে তাকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করা বুদ্ধিবৃত্তি ইনসাফের দাবী নয় বরং কোন সাহাবীর ভুলকে ভুল বলে স্বীকার না করা দ্বীনেরও দাবী হতে পারে না। কিন্তু সত্য কথা এই যে, একটি দিক বাদে অন্য সব দিক থেকে তাঁর চরিত্র খলীফা হিসাবে একটা আদর্শ চরিত্র ছিল, যার বিরুদ্ধে, আপত্তি উত্থাপন করার কোন অবকাশই নেই। উপরন্ত তাঁর খেলাফত কালে সামগ্রীকভাবে সুকৃতি এত প্রবল ছিল এবং তাঁর শাসনামলে ইসলামের বিজয়ের এত বড় কাজ সম্পন্ন হচ্ছিল যে, এ বিশেষ দিকটির ব্যাপারে জনগণ আশ্বস্ত না হওয়া সত্ত্বেও গোটা সাম্রাজ্যের কোথাও সাধারণ মুসলমানরা তাঁর গভর্ণর সাঈদ ইবনুল আ’স-এর কর্মধারায় অসন্তুষ্ট হয়ে কিছু লোক বিদ্রোহ সৃষ্টির চেষ্টা করলেও জনগণ তাতে সাড়া দেননি। হযরত ওসমান (রাঃ) এর পক্ষ থেকে হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) জনগণকে বায়আত নবায়নের জন্য আহ্বান জানালে বিদ্রোহের পতাকাবাহীরা ছাড়া সকলেই ছুটে আসেন। —[ তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩২-৩৩, তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৭২। ]
যার কারণে যে ক্ষুদ্র দলটি তাঁর বিরুদ্ধে গোলযোগের জন্য এগিয়ে আসার চেষ্টা করছিল, তারা ব্যাপক বিদ্রোহের আহ্বান জানাবার পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের পথ অবলম্বন করে। এ আন্দোলনের পতাকাবাহীদের সম্পর্ক ছিল মিসর, কুফা এবং বসরার সাথে। তারা পারস্পরিক পত্র বিনিময় করে অকস্মাৎ মদীনা আক্রমণের জন্য গোপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা হযরত ওসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে অভিযোগের এক বিরাট ফিরিস্তি প্রণয়ন করে, যার অধিকাংশই ছিল ভিত্তিহীন বা এমন দুর্বল অভিযোগ সম্বলিত, যার যুক্তিপূর্ণ জবাব দেয়া যায়, এবং পরে তা দেয়াও হয়েছে। এদের সংখ্যা দু’হাজারের বেশী ছিল না। পারস্পরিক চুক্তি অনুযায়ী তারা মিসর, কুফা এবং বসরা থেকে একযোগে মদীনা পৌঁছে।
তারা কোন অঞ্চলেরই প্রতিনিধি ছিল না, বরং চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের একটা দল গঠন করেছিল। মদীনার নিকটে পৌঁছে তারা হযরত আলি (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ)-কে নিজেদের দলে ভিড়াবার চেষ্টা করে; কিন্তু বুযুর্গত্রয় তাদেরকে হাঁকিয়ে দেন। হযরত আলি (রাঃ) তাদের প্রত্যেকটি অভিযোগের জবাব দিয়ে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ভূমিকা সুস্পষ্ট করেন। মদীনার মোহাজের ও আনসারগণ, যারা তদানীন্তন ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌল প্রাণশক্তি রূপে চিহ্নিত ছিল, তাদের সহায়ক হতে প্রস্তুত হয়নি। কিন্তু তারা নিজেদের হটকারিতায় অটল থাকে এবং অবশেষে তারা মদীনায় প্রবেশ করে হযরত ওসমান (রাঃ)- এর গৃহ অবরোধ করে। তাদের দাবী ছিল, মারওয়ান ইবনে হাকাম-কে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, অন্যথায় হযরত ওসমান (রাঃ)-কে খেলাফত ত্যাগ করতে হবে। হযরত ওসমান (রাঃ)- এর জবাব ছিল, আমি তোমাদের যে কোন সঠিক এবং বৈধ অভিযোগ শুনতে প্রস্তুত, কিন্তু তোমাদের কথা মতো পদত্যাগের প্রস্তুত নই। —[ তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা – ৬৬। ]
এরপর তারা ৪০ দিন ধরে গোলযোগ চালাতে থাকে; এ গোলযোগ চলাকালে তাদের দ্বারা এমনসব কাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যা মদীনাতুর রাসুল-এ ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি। এমনকি, তারা উম্মুলমু’মিনীন হযরত উম্মে হাবীবা (রাঃ)-কে অপমান করে। 'এ অনাচারের সয়লাব ধারায় আমিও কি নিজের ইযযাত বিকিয়ে দেবো?'—এই বলে হযরত আয়েশা (রাঃ) মদীনা থেকে মক্কা চলে যান। শেষ পর্যন্ত তারা মারাত্মক হাঙ্গামা সৃষ্টি করে একান্ত নির্মমভাবে হযরত ওসমান (রাঃ)-কে শহীদ করে ফেলে। তিনদিন যাবৎ তার দেহ মোবারক দাফন থেকে বঞ্চিত থাকে। তাঁকে হত্যা করার পর জালেমরা তাঁর গৃহও লুট করে। —[বিস্তারিত বিবরণের জন্য আত-তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৭৬ থেকে ৪১৮ এবং আল-বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৮ থেকে ১৯৭ দ্রষ্টব্য।]
কেবল হযরত ওসমান (রাঃ)- এর উপরই নয়, বরং স্বয়ং ইসলাম এবং খেলাফতে রাশেদার ব্যবস্থার উপর এটা ছিল তাদের বিরাট জুলুম। তাদের অভিযোগের মধ্য থেকে যদি কোনটির একটুও গুরুত্ব থেকে থাকে তাহলে তা ছিল কেবলমাত্র একটির, যা ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। সে অভিযোগ দূর করার জন্য কেবল এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, তারা মদীনা শরীফের মোহাজের ও আনসার এবং বিশেষ করে বড় বড় সাহাবীদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের মাধ্যমে হযরত ওসমান (রাঃ)- কে সংশোধনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতো। এ ব্যাপারে হযরত আলি (রাঃ) চেষ্টাও শুরু করেছিলেন এবং হযরত ওসমান (রাঃ) ভুলগুলো শুধরে নেবার ওয়াদাও করেছিলেন। —[আত-তাবারী, ৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা- ৩৭৬, ৩৭৭, ৩৮৪, ৩৮৫, আল-বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৭১, ১৭২।]
উপরন্ত এসব অভিযোগ দূর না হলেও সে জন্য খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার এবং তাঁর পদচ্যুতি দাবী করার শরীয়ত সম্মত কোন বৈধতা আদৌ ছিল না; কিন্তু তারা খলীফার পদচ্যুতির জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। অথচ বসরা, কুফা এবং মিসরের মাত্র দুই হাজার লোক, তাও তারা নিজ নিজ এলাকার প্রতিনিধিও নয়, গোটা মুসলিম জাহানের খলীফাকে পদচ্যুতি করার অথবা তাঁর পদচ্যুতি দাবী করার কোন অধিকারই তারা পেতে পারে না। খলীফার প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের অবশ্যই ছিল; অধিকার ছিল তাদের অভিযোগ উত্থাপন করার। নিজেদের অভিযোগ দূর করার দাবী জানাবার অধিকারও তাদের ছিল। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের মূল শক্তি তৎকালীন ইসলামী শাসনতন্ত্র অনুযায়ী যাকে খলীফা বানিয়েছে, আর বিশ্বের সকল মুসলমান যাকে খলীফা বলে স্বীকার করে নিয়েছে, কতিপয় লোক তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়ে কোন প্রতিনিধিত্বশীল মর্যাদা ছাড়াই নিছক নিজেদের অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁর পদচ্যুতি দাবী করবে, তাদের অভিযোগের প্রকৃতই কোন মূল্য আছে কিনা, সে প্রশ্ন দিলেও-এ অধিকার তাদের অদৌ ছিল না। —[হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ)-কে এ কথাই বলেছিলেন।]
কিন্তু তারা এতটুকু বাড়াবাড়ি করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং শরীয়তের সকল সীমা লংঘন করে খলীফাকে হত্যা করে, তাঁর বাসভবন লুট করে। হযরত ওসমান (রাঃ)-র যে সকল কাজকে তারা অপরাধ মনে করতো, তা অপরাধ হলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তাকে এমন কোন অপরাধ হিসেবে প্রমাণ করা যাবে না, যে জন্য কোন মুসলমানের রক্ত হালাল হতে পারে। এ কথাই বলেছিলেন হযরত ওসমান (রাঃ) তাঁর এক ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, 'শরীয়ত মতে একজন লোক তো কতিপয় নির্দিষ্ট অপরাধের কারণে হত্যার যোগ্য হয়। আমি তো সে সব অপরাধের কোনটিই করিনি। তাহলে কি কারণে তোমরা নিজেদের জন্য আমার রক্ত হালাল করছ?' —[আল-বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা – ১৭৯।]
কিন্তু যারা শরীয়তের নাম নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করছিল, তারা নিজেরা শরীয়তের কোন পরওয়াই করেনি। কেবল তাঁর রক্তই নয় বরং সম্পদও নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়েছিল তারা। এখানে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, মদীনাবাসীরা তাদের এ কাজে সন্তুষ্ট ছিল। আসল ঘটনা এই যে, ওরা আকস্মাৎ মদীনায় প্রবেশ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাটিগুলো অধিকার করে শহরবাসীদেরকে নিরুপায় করে দেয়। —[আল- বিদায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৯৮।]
উপরন্তু তারা হত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ সত্যি সত্যিই করেই বসবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মদীনাবাসীদের জন্য এটা ছিল একান্ত অপ্রত্যাসিত ঘটনা, যা আকাশ থেকে অকস্মাৎ বজ্রপাতের ন্যায় তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল। পরে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিজেদের শৈথিল্যের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিল। —[তাবকাতে ইবনে সায়াদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৭১।]
সবচেয়ে বড় কথা এই যে, স্বয়ং হযরত ওসমান (রাঃ) এ পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিলেন। তিনি নিজের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মদীনাতুর রাসুল-এ মুসলমানদেরকে পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি সমস্ত প্রদেশ থেকে সৈন্য বাহিনী তলব করে অবরোধকারীদের উচিৎ শিক্ষা দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা থেকে বিরত থাকেন। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ) তাঁকে বলেছিলেন, 'আপনার সমর্থনে সকল আনসার লড়তে প্রস্তুত।' কিন্তু তিনি জবাব দেন, 'না, যুদ্ধ করা যাবে না।' তিনি হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ)-কেও এ কথা বলেন। সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষ থেকে পদচ্যুতির দাবী তীব্র হয়ে উঠলে হযরত ওসমান (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, 'এখন আমাকে কি করতে হবে?' তিনি বলেন, 'কিছু লোক তাদের আমীরের ওপর অসুন্তুষ্ট হলে তাকে পদচ্যুত করবেন, মুসলমানদের জন্য আপনি এ পথ খুলবেন না।' —(তাবাকাতে ইবনে সা’আদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৬৬)।
আবার এ কথা তিনি বলেছিলেন পদচ্যুতির দাবীদারের জবাবদানকালে অবরোধকারীদের উদ্দেশ্য— 'আমি কি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করেই তরবারীর জোরে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেছি যে, তোমরা আমাকে তরবারীর জোরে পদচ্যুত করতে চাও?' —( তাবাকাতে...পৃষ্ঠ- ৬৮) আমি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নই। প্রাণপনে যুদ্ধ করার জন্য ৭ শত ব্যক্তি তাঁর মহলেই উপস্থিত ছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি তাদেরকেও নিবৃত্ত রাখেন। —[ তাবাকাতে.......৭০ –৭১ পৃষ্ঠা। ]
সত্য বলতে কি, অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে হযরত ওসমান (রাঃ) এমন কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেন, যা একজন খলীফা এবং বাদশার পার্থক্য সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। তাঁর পরিবর্তে ওখানে কোন বাদশাহ হলে নিজের গদি রক্ষার জন্য যে কোন পন্থা অবলম্বনেই তিনি কুণ্ঠিত হতেন না। তার হাতে মদীনা শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলে, আনসার ও মোহাজেরদের পাইকারী ভাবে হত্যা করা হলে, রাসুলের পবিত্র স্ত্রীগণকে অপমান করা হলে এবং মসজিদে নবব্বী ভেঙ্গে মাটির সাথে মিসিয়ে দেওয়া হলেও তিনি তার পরওয়া করতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন খলীফায়ে রাশেদা, সত্য ও ন্যায়ের পথে অভিসারী খলীফা। একজন আল্লাহভীরু শাসনকর্তা আপন গদি রক্ষার জন্য কতটুকু পারা যায়, কোথায় গিয়ে তাকে থেমে যেতে হয়, একান্ত কঠিন মুহুর্তেও তিনি তৎপ্রতি লক্ষ রেখেছেন। মুসলমানের ইজ্জত-আবরু বিকিয়ে দেয়ার চেয়ে নিজের প্রাণ দানকে তিনি অতি ক্ষুদ্র কাজ বিবেচনা করেছেন। কারণ, মুসলমানের ইজ্জত-অবরু একজন মুসলমানের নিকট দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিকতর প্রিয় হওয়াই বাঞ্চনীয়।
তৃতীয় পর্যায়—
হযরত ওসমান (রাঃ)-র শাহদাতের পর মদীনায় নৈরাজ্য বিস্তার লাভ করে। কারণ, উম্মতের তখন কোন নেতা নেই, রাষ্ট্রের নেই কোন কর্ণধার; বহিরাগত সন্ত্রাসীদের জয়ে মদীনার মোহাজের-আনসার এবং বড় বড় তাবেয়ীরা সকলেই অস্থির। রোম সীমান্ত থেকে ইয়ামেন পর্যন্ত এবং আফগানিস্তান থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এ উম্মত এবং বিশাল সম্রাজ্য নেতা শূন্য অবস্থায় কয়েক দিনও কি করে চলতে পারে? যতোশীঘ্র সম্ভব একজন খলীফা নির্বাচন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, আর এ নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে মদীনায়। কারণ, মদীনাই হচ্ছে ইসলামের কেন্দ্র ভূমি। ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ইসলামী ও ইসলামী ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ইসলামের মূল প্রাণশক্তি যে জনতা, যাদের বায়আতে এ যাবৎ খেলাফত সংঘটিত হয়ে আসছে, তারাও মদীনায় উপস্থিত। কাজেই এ ব্যাপারে কোন বিলম্ব করার অবকাশ ছিল না। মদীনার বাইরের দূর-দরায শহর বন্দরের দিকে দৃষ্টি দেবারও কোন প্রয়োজন ছিল না। এক মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। উম্মতকে সংগঠিত করার জন্য, রাষ্ট্রকে বিশৃংখলার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তৎক্ষণাৎ কোন যোগ্যতর ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্র প্রধান নিযুক্ত করা অপরিহার্য ছিল।
হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর ওফাতকালে যে ছ’জন সাহাবীকে উম্মাতের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ব্যক্তি বলে অভিহিত করে গিয়েছিলেন, তখন তাদের মধ্য থেকে ৪ জন হযরত আলী (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ), হযরত যোবায়ের (রাঃ), হযরত সা'আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) জীবিত ছিলেন। এদের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) সকল দিক থেকে প্রথম সারিতে ছিলেন। শুরা উপলক্ষে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) উম্মাতের জনমত যাচাই করে এ ফায়সালা দেন যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পরে যিনি উম্মতের সবচেয়ে বেশী আস্থাভাজন ব্যক্তি, তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (রাঃ)। —[আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৬।]
সুতরাং জনগণ খেলাফতের জন্য তাঁর প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, এটাই ছিল একান্ত স্বাভাবিক। কেবল মদীনায়ই নয়, বরং গোটা মুসলিম জাহানে তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিই ছিলেন না, যিনি এ উদ্দেশ্যে মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন। এমনকি বর্তমান কালের প্রচলিত পন্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তিনি অবশ্যই বিপুল ভোটে জয় লাভ করতেন। —[ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেন, তখন হযরত আলী (রাঃ)-এর চেয়ে খেলাফতের যোগ্যতার অন্য কোন ব্যক্তি ছিল না; আল-বেদায়া...., ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩০।] তাই তো সকল নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সাহাবী এবং মদীনার অন্যান্য লোকেরা তাঁর নিকট গিয়ে বলেন, 'কোন আমীর ছাড়া এ ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। জনগণের জন্য একজন ইমাম অপরিহার্য। আজ এ পদের জন্য আপনার চেয়ে অন্য কোন যোগ্য ব্যক্তি আমরা দেখছি না। অতীতের খেদমত এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নৈকট্য কোন বিচারেই না।'
তিনি অস্বীকৃতি জানান। লোকেরা পীড়াপীড়ি করতে থাকে। অবশেষে তিনি বলেন, 'গৃহে বসে গোপনে আমার বায়াত হতে পারে না। সাধারণ মুসলমানের সন্তুষ্টি ব্যতিত এমনটি হওয়া সম্ভব নয়।' অতঃপর মসজিদে নববীতে সাধারণ অধিবেশন বসে এবং সকল মোহাজের-আনসার তাঁর হাতে বায়াত করেন। সাহাবীদের মধ্যে ১৭ জন বা ২০ জন এমনও ছিলেন, যাঁরা তাঁর হাতে বায়াত করেন নি। —[আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৫০, ৪৫২; আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৫, ২২৬।] ইবনে আবদুল বার-এর বর্ণনা মতে, সিফফিন যুদ্ধে এমন ৮ শত সাহাবী হযরত আলী (রাঃ)-র সঙ্গে ছিলেন, যারা বায়আতুর রেযওয়ানের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন; আল-এস্তীআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২৩।
যে'সব নীতির ভিত্তিতে খেলাফতে রাশেদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব, হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত নিশ্চিতরূপে সে সব মূলনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। উপরের বিবরণী থেকে এ কথা সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হয়। তিনি জোর করে ক্ষমতা দখল করেননি। খেলাফত লাভের জন্য তিনি সামান্যতম কোন চেষ্টা তদবীরও করেননি। জনগণ নিজেরা স্বাধীন পরামর্শক্রমে তাঁকে খলীফা নির্বাচিত করেন। সাহাবীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। পরে কেবলমাত্র শ্যাম প্রদেশ ব্যতীত গোটা মুসলিম জাহান তাঁকে খলীফা বলে স্বীকার করে। হযরত সাআদ ইবনে ওবায়দা (রাঃ)-র বায়াত না করায় যদি হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফত সন্ধিগ্ধ না হয়, তাহেল ১৭ জন বা ২০ জন সাহাবীর বায়আত না করায় হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত কি করে সন্ধিগ্ধ সাব্যস্ত হতে পারে? উপরন্তু সে ক’জন সাহাবীর বায়আত না করা ছিল নিছক একটি নেতিবাচক কাজ; যার ফলে খেলাফতের আইনগত পজিশনের উপর কোন প্রভাব পড়ে না। তাঁর মুকাবিলায় কি এমন কোন খলীফা ছিল, যার হাতে তাঁরা প্রতি-বায়াত করেছিলেন? অথবা তাঁরা কি বলেছিলেন যে, এখন উম্মত বা রাষ্ট্রের কোন খলীফার প্রয়োজন নেই? অথবা তাঁরা কি বলেছিলেন যে, কিছু সময়ের জন্য খেলাফতের পদ শূন্য থাকা উচিত? এর কোন একটিও যদি না থাকে, তাহলে তাঁদের নিছক বায়াত না করার এ অর্থ কেমন করে হতে পারে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যাঁর হাতে বায়আত করেছে, মূলতঃ তিনি বৈধ খলীফা ছিলেন না?
এভাবে হযরত ওসমান (রাঃ)-র শাহাদাতের কালে খেলাফতে রাশেদার ব্যবস্থায় যে মারাত্মক ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমানরা তা পূরণ করার সুযোগ লাভ করেছিল এবং সুযোগ লাভ করেছিলেন হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করায়। কিন্তু তিনটি বিষয় এমন ছিল, যা সে ফাটল পুরণের সুযোগ দেয়নি। বরং তা ফাটলকে আরও বৃদ্ধি করে উম্মতকে মুলুকিয়্যাতের (রাজতন্ত্র) মুখে ঠেলে দেয়ার ব্যাপারে এক ধাপ অগ্রসর হয়।
১) হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, যারা কার্যত হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছিল, হত্যায় প্রেরণা যুগিয়েছিল এবং তাতে সহায়তা করেছিল, এমনি করে সামগ্রিকভাবে এ মহা বিপর্যয়ের দায়িত্ব যাদের উপর পড়ে তারা সবাই হযরত আলী (রাঃ)- কে খলীফা করার ব্যাপারে অংশ নেয়। খেলাফত কার্যে তাদের অংশ গ্রহণ এক বিরাট বিপর্যের কারণ হয়ে পড়ে। কিন্তু মদীনার সে সময়ের পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য যে ব্যক্তিই চেষ্টা করবেন, তিনি এ কথা উপলব্ধি না করে পারবেন না যে, তখন খলীফা নির্বাচনের কাজ থেকে তাদেরকে কিছুতেই নিবৃত্ত করা যেত না। তাদের অংশ গ্রহণ সত্ত্বেও যে ফায়সালা গৃহীত হয়েছিল, তা ছিল অবশ্যি একটি সঠিক ফায়সালা। উম্মতের সকল প্রভাবশালী ব্যক্তি ঐকমত্যের ভিত্তিতে হযরত আলী (রাঃ)-এর হস্ত সুদৃঢ় করলে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদেরকে নিশ্চিত দমন করা সম্ভব হত এবং দুর্ভাগ্য বশতঃ বিপর্যয়ের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল, তা সহজেই নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হত।
২) হযরত আলী (রাঃ)-এর বায়আত থেকে কোন কোন বড় সাহাবীর বিরত থাকা— কোন কোন বুযর্গ একান্ত সদুদ্দেশ্যে ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য এ কর্মপন্থা অবলম্বন করলেও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছে যে, যে ফেতনা থেকে তাঁরা দূরে থাকতে চেয়েছিলেন, তাদের এ কাজ তার চেয়েও বড় ফেতনার সহায়ক হয়েছে। তাঁরা ছিলেন উম্মতের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের প্রত্যেকের উপর হাজার হাজার মুসলমানের আস্থা ছিল। তাঁদের বিরত থাকার ফলে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়, খেলাফতে রাশেদার ব্যবস্থা নব পর্যায়ে বহাল করার জন্য যে একাগ্রতার সাথে হযরত আলী (রাঃ)-এর সহযোগিতা করা উম্মাতের উচিত ছিল, যা ছাড়া তিনি এ কাজ আঞ্জাম দিতে পারতেন না, দুর্ভাগ্যবশত তা অর্জিত হতে পারেনি।
৩) হযরত ওসমান (রাঃ)-এর রক্তের দাবী। দু’পক্ষ দুটি দল এ দাবী নিয়ে এগিয়ে আসে— এক দিকে হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং হযরত তালহা (রাঃ) ও হযরত যোবায়ের (রাঃ) এবং অপর পক্ষে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)। উভয় পক্ষের মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেও এ কথা না বলে উপায় নেই যে, আইনের দৃষ্টিতে উভয় পক্ষের পজিশনকে কিছুতেই সঠিক বলে স্বীকার করা যায় না। বলাবাহুল্য এটা জাহেলী যুগের কোন গোত্রবাদী ব্যবস্থা ছিল না; যে কোন ব্যক্তি যেভাবে খুশী নিহত ব্যক্তির প্রতিশোধের দাবী নিয়ে দাঁড়াবে, আর সে দাবী পূরণ করার জন্য ইচ্ছা মতো যে কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করবে; এ ধরনের কোন ব্যবস্থা তখন ছিল না। সেখানে একটা বিধিবদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রতিটি দাবী উত্থাপন করার জন্য একটা নিয়ম এবং একটা বিধান বর্তমান ছিল। হ্ত্যার প্রতিশোধ দাবী করার অধিকার নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারদের ছিল, তাঁরা বেঁচে ছিলেন এবং সেখানে উপস্থিতও ছিলেন। অপরাধীদের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ব্যাপারে সরকার সত্যিই জেনে শুনে শৈথিল্য প্রদর্শন করলে অন্যরা নিশ্চয়ই সরকারের নিকট ইনসাফের দাবী জানাতে পারতেন। কিন্তু সরকার কোন ব্যক্তির দাবী অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ না করলে তিনি যে সরকারকে আদৌ কোন বৈধ সরকার বলে স্বীকারই করবেন না, কোন সরকারের কাছে ইনসাফ দাবী করার এটা কোন ধরনের পন্থা হতে পারে? শরীয়তের কোথাও কি এর কোন নজির আছে? হযরত আলী (রাঃ) যদি বৈধ খলীফাই না হবেন, তবে তাঁর কাছে অপরাদীদের গ্রেফতার এবং শাস্তি বিধান দাবী করার অর্থই বা কি? তিনি কি কোন গোত্রীয় সর্দার ছিলেন যিনি আইনগত অধিকার ছাড়াই যাকে খুশী পাকড়াও করবেন এবং যাকে খুশী শাস্তি দেবেন?
এর চেয়েও বেশী বিরোধী পন্থা ছিল প্রথম পক্ষের। তারা মদীনায় গিয়ে, যেখানে খলীফা, অপরাধী এবং নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী সকলেই উপস্থিত ছিলেন এবং অপরাধীর বিচার ও দণ্ড বিধান সম্ভবপর ছিল, নিজেদের দাবী পেশ করার পরিবর্তে বসরার পথে গমন করেন, এবং সৈন্য সমাবেশ করে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করেন। তাদের এ দাবীর অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ এক খুনের পরিবর্তে আরো দশ হাজার খুন হওয়া এবং রাষ্ট্রের শৃংখলা বিপন্ন হওয়াই ছিল অবধারিত। শরীয়ত তো দূরের কথা, দুনিয়ার কোন আইনের দৃষ্টিতেই এটাকে বৈধ কার্যক্রম হিসাবে স্বীকার করা চলে না, যাবে না।
দ্বিতীয় পক্ষ, অর্থাৎ হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-র কর্মপন্থা ছিল এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশী আইন বিরোধী। আবু সুফিয়ান তনয় মুআবিয়া হিসাবে নয়, বরং শ্যাম প্রদেশের গভর্ণর হিসাবে তিনি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের দাবী উত্থাপন করেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। নিজের উদ্দেশ্যের জন্য গভর্ণরীর ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তিনি। হযরত আলী (রাঃ)- এর নিকট তিনি এ দাবী উত্থাপন করেননি যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাদেরকে শাস্তি দান করতে হবে। বরং তার দাবী ছিল হস্তাদেরকে তাঁর হাতে সোপর্দ করতে হবে, যাতে তিনি নিজে তাদেরকে হত্যা করতে পারেন। —[তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩, ৪, ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৮, আল-বেদায়া, ওয়ান নেহায়া, পৃষ্ঠা- ২৫৭-২৫৮।] এসব কিছু ইসলামী যুগের সুশৃংখল সরকারের পরিবর্তে ইসলাম পূর্ব যুগের গোত্রীয় বিশৃংখলার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। প্রথমতঃ হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীর অধিকার ছিল হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-র পরিবর্তে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শরীয়ত সম্মত উত্তরাধিকারীদের। আত্মীয়তার ভিত্তিতে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর এ দাবী করার অধিকার থাকলেও তা ছিল ব্যক্তিগতভাবে, শ্যাম-এর গভর্ণর হিসাবে নয়।
হযরত ওসমান (রাঃ)- এর আত্মীয়তা ছিল আবু সুফিয়ানের পুত্র মুআবিয়ার সাথে; শ্যাম-এর গভর্ণরী তাঁর আত্মীয়তার ভিত্তি ছিল না। ব্যক্তিগত মর্যাদায় তিনি খলীফার নিকট ফরিয়াদী হিসাবে যেতে পারতেন, দাবী করতে পারতেন অপরাধীদের গ্রেফতার করার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার। যে খলীফার হাতে যথারীতি আইনানুগ উপায়ে বায়'আত সম্পন্ন হয়েছে, একমাত্র তাঁর প্রশাসনাধীন প্রদেশ ছাড়া অবশিষ্ট গোটা দেশ যাঁর খেলাফত মেনে নিয়েছে, [ঐতিহাসিকভাবে একথা প্রমাণিত যে, সিপফীন যুদ্ধের পর পর্যন্ত গোটা জাজিরাতুল আরব এবং শ্যাম-এর পূর্ব পশ্চিম উভয় দিকে ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিটি প্রদেশ হযরত আলী (রাঃ)-এর বায়'আতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। হযরত মুআবিয়ার প্রভাবাধীন হওয়ার কারণে কেবল শ্যাম প্রদেশ তাঁর আনুগত্য বহির্ভূত ছিল। এ জন্য এ অবস্থার সত্যিকার আইনগত মর্যাদা এই ছিল না যে, মুসলিম জাহানে নৈরাজ্য বিরাজ করছিল, সেখানে কেউ কারো আনুগত্য করতে বাধ্য ছিল না। বরং সঠিক আইনগত অবস্থা এই ছিল যে, রাষ্ট্রে একটি বৈধ, আইনানুগ কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যমান ছিল; অন্যান্য প্রদেশসমূহ তার আনুগত্য করছিল, কেবল একটি মাত্র প্রদেশ ছিল বিদ্রোহী- (আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬২-৪৬৩; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৭-১৪১; আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৯, ২৫১।)
খলিফার আনুগত্য অস্বীকার করার গভর্ণর হিসাবে তাঁর কোন অধিকার ছিল না। অধিকার ছিল না নিজের প্রশাসনাধীন অঞ্চলের সামরিক শক্তিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার। নিরেট প্রাচীন জাহেলিয়াতের পন্থায় এ দাবী করার অধিকারও তাঁর ছিল না যে, হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে আদালতের কার্যক্রম ছাড়াই কেসাসের দাবীদারদের হাতে সোপর্দ করা হোক, যাতে তিনি নিজেই তাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারেন।
কাযী আবুবকর আরাবী আহকামুল কুরআন-এ নিম্নোক্তভাবে এ বিষয়ের সঠিক শরীয়ত সম্মত মর্যাদা বর্ণনা করেছেন— 'হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর জনগণকে নেতাশূন্য ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল না, তাই হযরত ওমর (রাঃ) শূরায় যাদের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তাঁদের সামনে ইমামত (নেতৃত্ব) পেশ করা হয়। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। হযরত আলী (রাঃ) যিনি এর সবচেয়ে বেশী হকদার এবং যোগ্য ছিলেন তা গ্রহণ করেন, যাতে উম্মতের রক্তপাত এবং নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য থেকে রক্ষা করা যায়। সে রক্তপাত এবং অনৈক্যের ফলে দ্বীন এবং মিল্লাতের অপূরণীয় ক্ষতির আশংকা ছিল। তাঁর হাতে বায়আত করার পর শ্যাম প্রদেশের জনগণ তাঁর বায়আত কবুল করার জন্য শর্ত আরোপ করে যে, প্রথমে হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতার করে তাদের নিকট থেকে কেসাস (প্রতিশোধ) গ্রহণ করা হোক। হযরত আলী (রাঃ) তাদেরকে বলেন যে, 'আগে বায়আতে শামিল হয়ে যাও, পরে অধিকার দাবী করো, তোমরা অবশ্যই তা পাবে।' কিন্তু তারা বলে, ‘আপনি বায়আতের অধিকারীই নন। কারণ আমরা হযরত ওসমান (রাঃ)- এর হত্যাকারীদেরকে সকাল-বিকাল আপনার সঙ্গে দেখছি।’ এ ব্যাপারে হযরত আলী (রাঃ)-এর মত অধিক সত্য ছিল। তাঁর উক্তি ছিল একান্ত সঠিক। কারণ তিনি তখন হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করলে বিভিন্ন গোত্র তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতো। ফলে যুদ্ধের একটি তৃতীয় ফ্রন্ট খুলে যেতো। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন, সরকার সুদৃঢ় হোক, গোটা দেশে তাঁর বায়আত প্রতিষ্ঠিত হোক, এরপর আদালতে যথারীতি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের পক্ষ থেকে দাবী উত্থাপিত হবে, সত্য ও ন্যায়ানুযায়ী ফায়সালা করা হবে। যে অবস্থায় ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার এবং বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে, সে অবস্থায় ইমামের জন্য কেসাসকে বিলম্বিত করা বৈধ এ ব্যাপারে ওলামায়ে উম্মতের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই।'
'হযরত তালহা ও যোবায়ের (রাঃ)- এর ব্যাপারও ছিল অনুরূপ। তাঁরা উভয়ে হযরত আলী (রাঃ)-কে খেলাফত থেকে বেদখল করেননি, তাঁরা তাঁর দ্বীনের ব্যাপারেও আপত্তি জানাননি। অবশ্য তাঁদের মত ছিল, সর্বপ্রথম হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদেরকে দিয়েই সূচনা করা হোক। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) তাঁর মতে অটল ছিলেন এবং তাঁর মতই সঠিক ছিল।’
আরও এক ধাপ এগিতে কাযী সাহেব লিখেছেন, 'এ পরিস্থিতিতে হযরত আলী (রাঃ) কোর'নের আয়াত অনুযায়ী কাজ করেছেন। যেসব বিদ্রোহী ইমামের উপর নিজেদের মত জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এমন দাবীকরার অধিকার এ বিদ্রোহীদের ছিল না। যারা কেসাসের দাবী করছিল তাদের জন্য সঠিক পন্থা ছিল, হযরত আলী (রাঃ)-এর কথা মেনে নিয়ে কেসাসের দাবী আদালতে পেশ করে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা। তারা এ পন্থা অবলম্বন করলে হযরত আলী (রাঃ) যদি অপরাধীদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করতেন, তখন তাদের দ্বিধা-সংকোচেরও কোন প্রয়োজন হতো না। সাধারণ মুসলমানরা নিজেরাই হযরত আলী (রাঃ)-কে পদচ্যুত করতো। —[আহকামুল কুরআন, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭০৬-১৭০৭, মিসরীয় সংস্করণ, ১৯৫৮।]
চতুর্থ পর্যায়—
খেলাফতে রাশেদার মধ্যে এ তিনটি ফাটল সৃষ্টি হবার পর হযরত আলি (রাঃ) দায়িত্বভার গ্রহণ করে কাজ শুরু করে দেন। তিনি সবেমাত্র কাজ শুরু করেছেন, দু’হাজার সন্ত্রাসবাদী তখনও মদীনায় উপস্থিত, এমন সময় হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যোবায়ের (রাঃ) অন্যান্য কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে বলেনঃ ‘হদ’ (শরীয়াতের দন্ড বিধি) কায়েম করার শর্তে আমরা আপনার হাতে বায়আত করেছি। যারা হযরত ওসমান (রাঃ)- এর হত্যায় শরীক ছিল, এবার আপনি তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করুন। হযরত আলী (রাঃ) জবাবে বলেনঃ ভাইয়েরা আমার! আপনারা যতটুকু জানেন, আমিও তা অনবগত নই। কিন্তু আমি তাদেরকে কি করে পাকড়াও করবো, যারা এখন আমাদের ওপর প্রতিপত্তি বিস্তার করে আছে, যাদের ওপর এখন আমাদের কোন প্রভাব ও প্রতিপত্তি নেই। আপনারা এখন যা করতে চান, তার কি কোথাও কোন অবকাশ আছে? তাঁরা সকলেই জবাব দেয়, না। অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ আল্লার কসম। আপনারা যা চিন্তা করেন আমিও তাই চিন্তা করি। পরিস্থিতি একটু শান্ত হতে দিন, গণমনে স্বস্তি ফিরে আসুক। চিন্তার বিভ্রান্তি দূরীভূত হোক, অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হোক। [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৫৮। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১০০। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৭-২২৮।]
অতঃপর এ বুযুর্গদ্বয় হযরত আলি (রাঃ)-এর অনুমতি নিয়ে মক্কা শরীফ চলে যান। সেখানে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)- এর সাথে সাক্ষাৎ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কুফা ও বসরা থেকে, যেখানে হযরত তালহা ও হযরত যোবায়েরের বিপুল সংখ্যক সমর্থক ছিল, সেনাবাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করা হবে। সুতরাং এ কাফেলা মক্কা থেকে বসরা রওয়ানা হয়ে যায়। বনী-উমাইয়ার সাঈদ ইবনুল আ’স এবং মারওয়ান ইবনুল হাকামও কাফেলার সাথে গমন করেন। মাররুয যাহরান (বর্তমান ফাতেমা উপত্যকা) পৌঁছে সাঈদ ইবনুল আ’স তাঁর দলের লোকদের বললেন, তোমরা যদি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাও, তাহলে এদেরকে হত্যা করো, যারা এ বাহিনীতে তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। [হযরত তালহা (রাঃ) ও যোবায়ের (রাঃ) ইত্যকার বুযুর্গদের প্রতি তাদের ইঙ্গিত ছিল। কারণ, বনী-উমাইয়াদের সাধারণ ধারণা ছিল এই যে, যারা হযরত ওসমান (রাঃ)-কে হত্যা করেছে, কেবল তাঁরাই তাঁর হন্তা নয়, বরং সময়ে সময়ে যারা তাঁর পলিসীর সমালোচনা করেছে, বা সন্ত্রাসকালে যারা মদীনায় উপস্থিত ছিল, কিন্তু হত্যা প্রতিরোধের জন্য লড়াই করেনি, তারাও তার হত্যাকারীদের অন্তর্ভূক্ত।] মারওয়ান বললেন— না, আমরা তাদেরকে [অর্থাৎ হযরত তালহা (রাঃ), হযরত যোবায়ের (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ)-কে] পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করাবো। এদের মধ্যে যে পরাজিত হবে, সে এমনিতেই খতম হয়ে যাবে। আর যে বিজয়ী হবে, সে এতটা দুর্বল হয়ে যাবে যে, আমরা অতি সহজে তাকে কাবু করে ফেলবো। [তাবাকাতে ইবনে সা’আদ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪, ৩৫। ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট পৃষ্ঠা- ১৫৫।] এমনি করে এসব ব্যক্তিকে নিয়ে কাফেলা বসরায় পৌঁছে এবং তারা ইরাক থেকে তাদের সমর্থকদের এক বিশাল বাহিনী একত্র করে।
অপর দিকে হযরত আলী (রাঃ) মুয়াবিয়া (রাঃ)-কে খেলাফতের অনুগত করানোর জন্য শ্যাম যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বসরায় সৈন্য সমাবেশের কথা জানতে পেরে আগে এ পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে বাধ্য হন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবং তাঁদের প্রভাবাধিন ব্যক্তিবর্গ, যারা মুসলমানদের গৃহযুদ্ধকে স্বাভাবিকভাবেই একটা বিপর্যয় বলে মনে করতেন, এ অভিযানে তাঁর সহযোগী হতে প্রস্তুত ছিলেন না। [আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৩৩।] ফলে হত্যাকারীদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য হযরত আলী (রাঃ) সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, তারা হযরত আলী (রাঃ)-এর সংগৃহীত ক্ষুদ্র বাহিনীতে ঢুকে পড়ে। এটা তাঁর জন্য দুর্ণাম এবং বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (রাঃ)-এর সৈন্যবাহিনীর বসরার অদুরে পরস্পর মুখোমুখী হলে দ্বীনের শ্রীবৃদ্ধি ও কল্যাণকামী ব্যক্তিদের এক বিরাট গ্রুপ ঈমানদারদের দুটি দলকে সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে সমঝোতার কথাবর্তা প্রায় সম্পন্নই হয়ে এসেছিল। কিন্তু একদিকে হযরত আলী (ঃ)-এর সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীরা তারা মনে করতো, এদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেলে আমাদের রেহাই নেই; অপর দিকে উম্মুল মু’মিনীন-এর সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও ছিল, যারা উভয়কে সংঘর্ষে লিপ্ত করে দুর্বল করে ফেলার আকাংখা পোষণ করছিল। তাই তারা নিয়ম বহির্ভূত পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। অবশেষে উভয় পক্ষের কল্যাণকামীদের যুদ্ধ ঠেকাবার শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জামাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। —[আল-বেদায়া- ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৩৭-২৩৯।]
জামাল যুদ্ধের সূচনাকালে হযরত আলী (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ) ও হযরত যোবায়ের (রাঃ)-এর সাথে কথা বলার আকাংখা পোষণ করে এ মর্মে তাদের নিকট পয়গাম পাঠান তাঁরা উভযে হাজির হলে হযরত আলী (রাঃ) তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত থাকার উপদেশ দেন। ফলে হযরত যোবায়ের (রাঃ) যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে চলে যান, আর হযরত তালহা (রাঃ) প্রথম সারি থেকে পেছনের সারিতে সরে যান। [আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪১৫। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২২-১২৩। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪০, ২৪১, ২৪৭; আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২০৭; ইবনে খালদুন, ২য় খন্ডের পরিশিষ্ট পৃষ্ঠা- ১৬২।] কিন্তু আমর ইবনে জারমুয নামক জনৈক জালেম হযরত যোবায়ের (রাঃ)-কে হত্যা করে এবং প্রসিদ্ধ ও একান্ত নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে মারওয়ান ইবনুল হাকাম হযরত তালহা (রাঃ)-কে হত্যা করে। [তাবাকাতে ইবনে সা’আদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৩; ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮; ইবনে হাজার, তাহযীবুত তাহযীব, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২০; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৪; ইবনে আবদুল বার, আল-ইস্তীআব পৃষ্ঠা- ২০৭-২০৮; ইবনে আবদুল বার বলেন— মারওয়ান হযরত তালহা (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীতে শামিল ছিলেন, আর তিনিই হযরত তালহা (রাঃ)-কে হত্যা করেছেন- নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। আল্লামা ইবনে কাসীর আল-বেদায়া এ বর্ণনাকেই প্রসিদ্ধ বর্ণনা বলে স্বীকার করেছেন— আল-বেদায়া.......,৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৭।]
যাই হোক, সিফফীন যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এতে উভয় পক্ষের ১০ হাজার লোক শহীদ হয়। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর এটা ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুর্ঘটনা। এ ঘটনা উম্মতকে স্বৈরাচারের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয়। হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যে সেনাবাহিনী যুদ্ধ করেছিল, তার বেশীর ভাগ সংগৃহীত হয়েছিল বসরা এবং কুফা থেকেই। হযরত আলি (রাঃ)-এর হাতে এ এলাকার ৫ হাযার লোক শহীদ এবং হাজার হাজার লোক আহত হওয়ার পর কি করে এ আশা করা যেতে পারে যে, শ্যাম-এর জনগণ যে একাত্মতার সাথে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর সহযোগিতা করছিল, ঠিক একই পর্যায়ের একাত্মতার সাথে ইরাকের জনগণও হযরত আলী (রাঃ)-এর সহযোগিতা করবে? সিফফীন যুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী পর্যায়ে হযরত তুআবিয়া (রাঃ)-এর শিবিরের ঐক্য এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর শিবিরের অনৈক্য মৌলিকভাবে এ জামাল যুদ্ধের পরিণতি ছিল। এ যুদ্ধ সংঘটিত না হলে পরবর্তীকালের সকল বিকৃতি সত্ত্বেও স্বৈরাচারের আগমন ঠেকানো সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল। বস্তুত এটাই ছিল হযরত আলি (রাঃ) এবং তালহা (রাঃ) ও যোবায়ের (রাঃ)-এর সংঘাতের পরিণতি। এ পরিণতির অপেক্ষায় ছিলেন মারওয়ান ইবনুল হাকাম। সে জন্যেই তিনি হযরত তালহা (রাঃ) ও যোবায়ের (রাঃ)-এর সাথী হয়ে বসরায় যান। দুঃখের বিষয়, তাঁর এ অভিপ্রায় শতকরা একশ ভাগ পূর্ণ হয়।
হযরত আলি (রাঃ) এ যুদ্ধের ব্যাপারে যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেন, তা একজন খলীফায়ে রাশেদ এবং একজন বাদশার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। তিনি প্রথমে আপন সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘোষণা করেছেন, কোন পলায়নকারীর পেছনে ধাওয়া করবে না, কোন আহত ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করবে না এবং বিজয়ী হয়ে বিরোধীদের গৃহে প্রবেশ করবে না। বিজয় শেষে তিনি উভয় পক্ষের শহীদদের জানাযার সালাত আদায় করান এবং সমান মর্যাদার সাথে তাদেরকে দাফন করান। বিরোধী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া অর্থ-সম্পদকে গণীমতের মাল সাব্যস্ত করতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। বসরার জামে মসজিদে সংগৃহীত সম্পদ জড়ো করে তিনি ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি তার নিজের মাল চিনতে পারে সে যেন তা নিয়ে যায়। লোকেরা খবর রটায় আলি (রাঃ) বসরার পুরুষদের হত্যা করতে চান, আর চান স্ত্রীদের দাসীতে পরিণত করতে। হযরত আলি (রাঃ) তৎক্ষণাৎ এ অপপ্রচারের প্রতিবাদ করে বলেন— ‘আমার মতো লোক থেকে এ ধরনের আশংকা করা উচিত নয়, এ আচরণ তো কাফেরদের সাথে করার মতো। মুসলমানদের সাথে এহেন আচরণ করা যায় না।’ বসরায় প্রবেশ করলে স্ত্রীরা গৃহের অভ্যন্তর থেকে গালমন্দ এবং নিন্দাবাদে জর্জরিত করে। হযরত আলী (রাঃ) তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘোষণা করে দেন— সাবধান! কারোর সম্ভ্রম নষ্ট করবে না, কারো গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না, কোন নারীকে উত্যক্ত করবে না, – তারা তোমাদের আমীর এবং সৎ ব্যক্তিদেরকে গালমন্দ করলেও না। এরা যখন মুশরিক ছিল, তখনও তো এদের উপর হস্তক্ষেপ করা থেকে আমাদেরকে বারণ করা হয়েছিল। এখন তো এরা মুসলমান; তবে কি করে এখন এদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারি? —[আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫০৬, ৫১০, ৫৪২, ৫৪৪। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২২, ১৩১, ১৩২। আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৪, ২৪৫। ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্টি, পৃষ্ঠা- ১৬৪, ১৬৫।]
পরাজিত পক্ষের আসল পরিচালক হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করেন এবং পরিপূর্ণ মর্যাদার তাঁকে মদীনা প্রেরণ করেন। [আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৫, ২৪৬; আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৪৭।] হযরত যোবায়ের (রাঃ)-এর হন্তা এনাম লাভের আশায় উপস্থিত হলে তিনি তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দান করেন, তার হাতে হযরত যোবায়ের (রাঃ)-এর তরবারী দেখে বলেন, কতোবার এ তরবারী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হেফাযত করেছিল। [আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৯; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্টি, পৃষ্ঠা- ১৬২।] হযরত তালহা (রাঃ)-এর পুত্র সাক্ষাৎ করতে এলে অত্যন্ত আদরের সাথে তাকে নিকটে বসতে দেন, তাঁকে তার সম্পত্তি ফেরত দিয়ে বলেন, আমি আশা করি, আখেরাতে তোমার পিতা এবং আমার মধ্যে যে ঘটনা ঘটবে, তাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে এভাবে বর্ণনা করেছেন— 'আমি তাদের অন্তরের কলুষ-কালিমা বিদূরীত করবো, আর তারা ভাইয়ের মতো একে অন্যের সম্মুখে উচ্চাসনে উপবিষ্ট হবে।' —[তাবাকাতে ইবনে সাআদ, পৃষ্ঠা- ২২৪, ২২৫।]
পঞ্চম পর্যায়—
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের (৩৫ হিজরীর ১৮ই জিলহজ্জ) পর হযরত নোমান ইবনে বশীর তাঁর রক্তমাখা জামা, তাঁর স্ত্রী হযরত নায়েলার কাটা আঙ্গুল দামেশকে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট নিয়ে যান এবং শামবাসীদের ভাবাবেগকে নাড়া দেয়ার জন্য তিনি এগুলো প্রকাশ্য রাস্তায় ঝুলিয়ে রাখেন। [ ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৯৮; আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৭; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৫২।] হযরত মুআবিয়া (রাঃ) ওসমান (রাঃ) হত্যার প্রতিশোধ আইনানুগ পন্থায় নয়, বরং বেআইনী পন্থায় গ্রহণ করতে চান, এটা ছিল তারই প্রমাণ। অন্যথায় এটা স্পষ্ট যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের খবরই মানুষের মনে ক্ষোভ ও দুঃখ সঞ্চারের জন্য যথেষ্ট ছিল, জামা এবং আঙ্গুলের প্রদর্শনী করে মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করার কোন প্রয়োজন ছিল না।
এ'দিকে হযরত আলি (রাঃ) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বপ্রথম যে সমস্ত কাজ করেন, তার মধ্যে একটি ছিল ৩৬ হিজরীর মহররম মাসে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে শ্যাম থেকে বরখাস্ত করে তাঁর স্থানে হযরত সাহাল ইবনে হানীফের নিযুক্তি। কিন্তু নবনিযুক্ত গবর্ণর সবেমাত্র তাবুক পৌঁছেছেন, এমন সময় শ্যাম-এর একটি পদাতিক বাহিনী তাঁর সাথে মিলিত হয়ে বলে, আপনি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে এসে থাকলে আপনাকে খোশআমদেদ জানাই। কিন্তু অন্য কারো পক্ষ থেকে এসে থাকলে ফেরত চলে যান। [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১০৩; আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৮; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৫২।]
শ্যাম প্রদেশ নতুন খলীফার আনুগত্য গ্রহণে প্রস্তত নয় এটা ছিল তারই স্পষ্ট নোটিশ। হযরত আলি (রাঃ) অপর এক ব্যক্তিকে পত্র দিয়ে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি সে পত্রের কোন জবাবই দেননি। বরং ৩৬ হিজরীর সফর মাসে জনৈক দূতের মারফত তাঁর নিকট একখানা খাম পাঠান। হযরত আলি (রাঃ) খাম খুলে দেখেন, ভেতরে কোন চিঠি নেই। তিনি জিজ্ঞেস করেন, একি ব্যাপার? দূত জানায়, ‘ওসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আমার পেছনে ৬০ হাজার লোক উন্মুখ হয়ে আছে।’ হযরত আলি (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, কার কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চায়? সে জবাব দেয়, আপনার ঘাড়ের রগ থেকে। [আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬৪; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১০৪; আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৯; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৫২-১৫৩।] এর স্পষ্ট অর্থ ছিল যে, শ্যাম-এর গভর্ণর কেবল আনুগত্য স্বীকার করতে চান না, তা-ই নয়, বরং আপন প্রদেশের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত করতে চান, ওসমান (রাঃ)-এর হন্তাদের কাছ থেকে নয়; বরং তদানীন্তন খলীফার নিকট থেকে ওসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহন করাই তার উদ্দেশ্য।
এসব কিছুই ছিল হযরত মুআবিয়া (রাঃ) একাধারে ১৬/১৭ বছর ধরে এমন একটি প্রদেশের গভর্ণরের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার ফল। যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে যে প্রদেশের অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে শ্যাম ইসলামী খেলাফতের একটি প্রদেশের তুলনায় অনেকাংশে তাঁর রাজত্বে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ হযরত আলি (রাঃ) কর্তৃক হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে পদচ্যুত করার ঘটনা অনেকটা এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যার ফলে পাঠক মনে করে বসে যে, হযরত আলি (রাঃ)-এর মধ্যে দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণতার লেশমাত্রই ছিল না। মুগীরা ইবনে শোবা (রাঃ) তাঁকে বিজ্ঞতার সাথে এ কথা বুঝিয়েছিলেন যে, মুআবিয়া (রাঃ)-কে শুধু শুধু ক্ষেপিয়ে দিয়ে বিপদ ডেকে আনেন। অথচ সে'সব ঐতিহাসিকদের লিখিত ইতিহাস থেকে ঘটনার যে চিত্র সামনে ভেসে ওঠে, তা দেখে কোন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তি এ কথা অনুভব না করে পারেন না যে, হযরত আলি (রাঃ) হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর পদচ্যুতির নির্দেশ দানে বিলম্ব করলে তা হতো বড় ভুল। তাঁর এহেন পদক্ষেপ থেকে শুরুতেই এটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, হযরত মুআবিয়া (রাঃ) কোথায় দাঁড়িয়ে তাঁর ভূমিকা প্রচ্ছন্ন থাকলে আসলে তা প্রতারণার আচ্ছাদন বৈ আর কিছুই হতো না। তা হতো আরও মারাত্মক।
হযরত আলি (রাঃ) অতঃপর শ্যাম আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেন। তখন শ্যামকে আনুগত্যে বাধ্যকরা তাঁর জন্য তেমন কষ্টকর ছিল না। কারণ জাজিরাতুল আরব, ইরাক এবং মিসর তাঁর আদর্শানুগত। শ্যাম প্রদেশ একা তাঁর মুকাবিলায় বেশীক্ষণ টিকতে পারতো না। উপরন্তু একটি প্রদেশের গভর্ণর খলীফার বিরুদ্ধে তরবারী উন্মুখ করে দাঁড়াবে- মুসলিম জাহানের সাধারণ জনমতও কিছুতেই তা পসন্দ করতো না। বরং এ পরিস্থিতিতে শ্যামের জনগণের পক্ষেও এক জোট হয়ে খলীফার বিরুদ্ধে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে সাহায্য করা সম্ভব হতো না। কিন্তু একই সময়ে হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ) ও হযরত যোবায়ের (রাঃ)-এর পদক্ষেপ- যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি-পরিস্থিতির চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে দেয় এবং হযরত আলি (রাঃ)-কে শ্যাম অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে ৩৬ হিজরীর রবিউস সানী মাসে বসরা অভিমুখে রওয়ানা হতে হয়। —[ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১১৩।]
হিজরী ৩৬ সালের জমাদিউস সানী মাসে জামাল যুদ্ধ শেষ করে হযরত আলি (রাঃ) পুনরায় শ্যাম-এর দিকে মনোনিবেশ করেন এবং হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আল-বাজালীকে একখানা পত্র দিয়ে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট পাঠান। এর মাধ্যমে তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করা হয় যে, উম্মত যে খেলাফতের ব্যাপারে একমত হয়েছে, তাঁর উচিত তার আনুগত্য করা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভেদ সৃষ্টি না করা। কিন্তু তিনি দীর্ঘ সময় হযরত জারীরকে হ্যা বা না, কোন উত্তরই দেননি। বরং দিচ্ছি দিচ্ছি করে সময় কাটাতে থাকেন। হযরত আমর ইবনুল আ’স-এর পরামর্শক্রমে তিনি ফায়সালা করেন যে, হযরত আলী (রাঃ)-কে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার জন্য দায়ী সাব্যস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। তাঁদের উভয়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যুদ্ধের পরে হযরত আলি (রাঃ)-এর বাহিনী পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে তাঁর পতাকা তলে লড়তে সক্ষম হবে না; শ্যামবাসীদের মধ্যে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর পতাকাতলে যুদ্ধ করার জন্য যে মনোবল দেখা যায়, ইরাক সে মনোবল নিয়ে হযরত আলি( রাঃ)-এর সাহায্য করতে সক্ষম হবে না। [আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৬১; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪১-১৪২; আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫৩।] হযরত মুআবিয়া (রাঃ) যখন টালবাহানা করছিলেন সে সময় হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ দামেস্কে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাতে মিলিত হয়ে তাদেরকে এ কথা বলতে থাকেন যে, ওসমান (রাঃ) হত্যার সাথে হযরত আলি (রাঃ)-এর কোন সম্পর্ক নেই এবং এ ব্যাপারে তিনি দায়ীও নন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এতে শংকিত হন, হযরত আলি (রাঃ)-ই হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার জন্য দায়ী-এ মর্মে শ্যামবাসীদের সামনে সাক্ষ্য দেয়ার নিমিত্ত কতিপয় সাক্ষী তৈরী করার জন্য তিনি এক ব্যক্তিকে নিয়োজিত করেন। কাজেই ঐ ব্যক্তি পাঁচ জন সাক্ষী সংগ্রহ করে আনে। তারা জনগণের সামনে সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত আলি (রাঃ)-ই ওসমান (রাঃ)-কে হত্যা করেছেন। —[আল-ইস্তীয়াব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৮৯।]
এরপর হযরত আলি (রাঃ) ইরাক থেকে এবং হযরত মুআবিয়া (রাঃ) শ্যাম থেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে পরস্পরের দিকে অগ্রসর হন এবং ফোরাতের পশ্চিম প্রান্তে ‘আর-রাক্কার নিকটে অবস্থিত ‘সিফফীন’ নামক স্থানে উভয়পক্ষ মুখোমুখী হয়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর বাহিনী পূর্বেই ফোরাতের পানির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসে। তিনি প্রতিপক্ষ বাহিনীকে পানি ব্যবহারের অনুমতি দেননি। হযরত আলি (রাঃ)-এর সৈন্যরা যুদ্ধ করে তাদেরকে সেখান থেকে বেদখল করে। হযরত আলি (রাঃ) নিজের লোকদেরকে নির্দেশ দেন নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পানি নিতে থাকো এবং অবশিষ্ট পানি থেকে প্রতিপক্ষ সৈন্যদলকে উপকৃত হতে দাও। —[আত-তাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৬৮, ৫৬৯; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৫, ১৪৬; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭০।]
জিলহজ্জ মাসের প্রথম দিকে যথারীতি যুদ্ধ শুরু করার আগে হযরত আলি (রাঃ) হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি জবাব দেন, আমার নিকট থেকে চলে যাও, আমার এবং তোমাদের মধ্যে তরবারী ব্যতীত কিছুই নেই। [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭০।]
কিছুকাল যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পর হিজরী ৩৭ সালের মহররম মাসের শেষ পর্যন্ত তা মুলতবী রাখার চুক্তি সম্পাদিত হলে হযরত আলিআঁতকে (রঃ) হযরত আদী ইবনে হাতেম (রাঃ)-এর নেতৃত্বে পুনরায় একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। প্রতিনিধি দলটি হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে বলেন যে, সকলেই হযরত আলি (রাঃ)-এর ব্যাপারে একমত; কেবল আপনি এবং আপনার সঙ্গীরাই তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) জবাব দেন, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদেরকে যদি তিনি আমাদের হাতে সোপর্দ করেন, যাতে আমরা তাদেরকে হত্যা করতে পারি, তাহলে এর পরই আমরা তোমাদের কথা শুনবো এবং আনুগত্য গ্রহন করে জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত হবো। অতঃপর তিনি হযরত আলি (রাঃ)-এর নিকট একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। এ দলের নেতা ছিলেন হাবীব ইবনে মাসলামা আল-ফিহরী। তিনি হযরত আলি (রাঃ)-কে বলেন, আপনি হযরত ওসমান (রাঃ)-কে হত্যা করেননি, এ যদি আপনার দাবী হয়ে থাকে, তবে যারা হত্যা করেছে তাদেরকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন। আমরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর রক্তের বদলে তাদেরকে হত্যা করবো। অতঃপর আপনি খেলাফতের পদে ইস্তফা দিন, যাতে মুসলমানরা পারস্পরিক পরামর্শক্রমে যার ব্যাপারে একমত হয়, তাকে খলীফা বানাতে পারে। [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩, ৪; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৭, ১৪৮; আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫৭, ২৫৮; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭১।]
মহররম মাস শেষ হওয়ার পর হিজরী ৩৭ সালের সফর মাস থেকে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের সূচনাতেই হযরত আলি (রাঃ) নিজের বাহিনীর মধ্যে ঘোষণা করেন, সাবধান! তারা আক্রমণ চালাবার আগে নিজেদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের সূচনা করবে না। অতঃপর তোমরা তাদেরকে পরাজিত করলে কোন পলায়নকারীকে হত্যা করবে না, কোন আহত ব্যক্তির ওপর হাত তুলবে না, কাউকে নগ্ন করবে না, কোন নিহিত ব্যক্তির লাশ বিকৃত করবে না, কারো গৃহে প্রবেশ করবে না, তাদের অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন করবে না, নারীরা তোমাদেরকে গালি দিলেও তাদের গায়ে হাত লাগাবে না। —[তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৯।]
এ যুদ্ধের সময় এমন একটি ঘটনা সংঘটিত হয়, যা স্পষ্টত প্রমাণ করে দেয় যে, পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কে সত্যের ওপর আছে, আর কে মিথ্যার ওপর। ঘটনাটি ছিল এই যে, হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের, যিনি হযরত আলি (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীতে ছিলেন, হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হন। একটি বিদ্রেহী দল তোমাকে হত্যা করবে, হযরত আম্মার সম্পর্কে নবী করীম (সঃ)-এর এ উক্তি সাহাবীদের মধ্যে বহুল পরিচিত এবং প্রসিদ্ধ ছিল। মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, তাবরানী, বায়হাকী, মুসনাদে আবুদাউদ তায়ালেসী ইত্যকার হাদীসগ্রন্থে হযরত আবু সাঈদ খুদরী, আবু কাতাদা আনসারী, উম্মে সালমা, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স, আবু হুরায়রা ওসমান ইবনে আফফান, হুযায়ফা, আবু আইয়ুব আনসারী, আবুরাফে, খোযায়মা ইবনে সাবেত, আমর ইবনুল আ’স, আবুল ইউসর, আম্মার ইবনে ইয়াসের রাযিয়াল্লাহু আনহুম এবং আরও অনেক সাহাবী থেকে এ ধরনের রেওয়ায়াত বর্ণীত হয়েছে। ইবনে সাআদ তাঁর তাবাকাত-এর কয়েক সনদে এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। —[ইবনে সা’আদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫১, ২৫৩, ২৫৯।]
বিভিন্ন সাহাবা এবং তাবেয়ী হযরত আলি (রাঃ) এবং মুআবিয়া (রাঃ)-এর যুদ্ধে যারা সন্ধিহান ছিলেন, এ যুদ্ধে হক-এর ওপর রয়েছেন আর কে বাতিল-এর ওপর এ কথা জানার জন্য তাঁরা হযরত আম্মার (রাঃ)-এর শাহাদাতকে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। —[ইবনে সাআদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫৩, ২৫৯, ২৬১; আত-তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৭, ১৬৫।]
আবুবকর আল-জাসসাস তার আহকামুল কুরআন গ্রন্থে লিখেছেন, 'আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ করেন। তাঁর সাথে ছিলেন এমন সব বড় বড় সাহাবী এবং বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীগণ যাঁদের মর্যাদা সবার জানা আছে। এ যুদ্ধে তিনি ‘হক’-এর ওপর ছিলেন। যে বিদ্রোহী দল তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছে তারা ব্যতীত এ ব্যাপারে আর কেউ দ্বিমত পোষণ করে না। উপরন্ত নবী করীম (সাঃ) নিজে হযরত আম্মার (রাঃ)-কে বলে ছিলেন যে, একটি বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে। এটা এমন এক হাদীস, যা বিভিন্ন সূত্রের বর্ণিত হয়েছে এবং সাধারণ্যে সর্বসম্মতভাবে বিশুদ্ধ বলে গৃহীত হয়েছে। এমনকি, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট এ হাদীস বর্ণনা করলে তিনিও অস্বীকার করতে পরেননি। অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, আম্মারকে তারা হত্যা করেছে, যারা তাকে আমাদের বর্শার সামনে ঠেলে দিয়েছে। কুফা, বসরা, হেজায এবং শ্যাম-এর বাসিন্দাগণ সবাই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। —[আহকামুল ‘কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮৯২।]
ইবনে আবদুল বার 'আল ইস্তীআব'-এ লিখেন— ‘বিদ্রোহী দল আম্মার ইবনে ইয়াসেরকে হত্যা করবে- নবী করীম (সঃ) থেকে অসংখ্য হাদীসের মাধ্যমে এ কথা বর্ণিত হয়েছে; আর এ বর্ণনাটি বিশুদ্ধ হাদীসমূহের অন্যতম। [আল-ইস্তীআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২৪।]
হাফেজ ইবনে হাজার ‘আল-এসাবায়’ এ কথাই লিখেছেন। [আল-এসাবা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫০৬।] অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘আম্মার হত্যার পর এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‘হক’ হযরত আলি (রাঃ)-এর পক্ষে; আহলে সুন্নত এ ব্যাপারে একমত। অথচ ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে মতবিরোধ ছিল। [আল-এসাবা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫০২। তাহাযীবুত তাহযীব-এ ইবনে হাজার লিখেন— নবী (সাঃ) হযরত আম্মার(রাঃ)-কে বলেছিলেন, বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে, এ হাদীস উপর্যুপুরী বর্ণনায় তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে।]
হাফেজ ইবনে কাসীর আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়ায় হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে লিখেন, এ থেকে বিদ্রোহী দল কর্তৃক হযরত আম্মারের নিহত হবার যে খবর রাসূলুল্লাহ (সঃ) দিয়েছিলেন তার রহস্য উন্মেচিত হয়েছে, এ থকে এ কথাও স্পষ্ট হয়েছে যে, হযরত আলি (রাঃ) ‘হক’-এর উপর আছেন, আর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বিদ্রোহী। [আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭০।]
জামাল যুদ্ধ থেকে হযরত যোবায়ের (রাঃ)- এর সরে দাঁড়াবার অন্যতম কারণ এও ছিল যে, নবী করীম (সঃ)-এর এ উক্তি তাঁর স্মরণ ছিল। তিনি দেখতে পান যে, হযরত আলি (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীতে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসেরও রয়েছেন। [আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪১; ইবনে খালদুন, ২য় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৬২।]
কিন্তু হযরত আম্মারের শাহাদাতের খবর হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীতে পৌঁছিলে এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) তাঁর পিতা এবং হযরত মুআবিয়া (রাঃ) উভয়কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাণী স্মরণ করিয়ে দিলে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) তৎক্ষণাৎ এর ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা কি আম্মারকে হত্যা করেছি? তাঁকে তো সে-ই হত্যা করেছে, যে তাঁকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে। [আত-তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৯; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৮; আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৬৮, ২৬৯]° হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর এ ব্যাখ্যা এ ব্যাখ্যা সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন, তিনি যে ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। মোল্লা আলী কারী ফিকহে আকবর-এর ভাষ্যে এ বর্ণনা উল্লেখ করেন যে, তাঁর এ ব্যাখ্যা সম্পর্কে হযরত আলি রা জানতে পেরে বলেনঃ এ ধরনের ব্যাখ্যা থেকে এ কথাও তো বলা চলে যে, নবী করীম (সাঃ) নিজেই হযরত হামজা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ছিলেন। – ফিকহে আকবর-এর ভাষ্য, পৃষ্ঠা-৭৯; দিল্লীর মুজতাবায়ী প্রেস সংস্করণ দ্রষ্টব্য। অথচ নবী করীম (সাঃ) এ কথা বলেননি যে, বিদ্রোহী দল হযরত আম্মারকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিয়ে আসবে; বরং তিনি বলেছিলেন যে, বিদ্রোহী দল তাঁকে হত্যা করবে, এ কথা সুস্পষ্ট যে, তাঁকে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর দল হত্যা করেছে, হযরত আলি (রাঃ)- এর দল নয়।
হযরত আম্মার (রাঃ)- এর শাহাদাতের দ্বিতীয় দিন, ১০ই সফর তুমুল যুদ্ধ হয় হযরত মুআবিয়া (রাঃ)- এর সেনাবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এ সময় হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে পরামর্শ দেন, এখন আমাদের সেনাবাহিনীর বর্শার অগ্রভাগে কুর'আন বেঁধে ঘোষণা করা উচিত— আল-কুর'আনই তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে ফায়সালা করবে। হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) নিজে এর স্বপক্ষে যুক্তি দেখান যে, এতে হযরত আলি (রাঃ)-এর বাহিনীর মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হবে। এক দল বলবে, তা মেনে নেয়া হোক, আর এক দল বলবে, না, তা মানা যায় না। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো, আর তাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হবে। তারা মেনে নিলে আমরা হাতে সময় পেয়ে যাবো। [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪; ইবনে সাআদ, ৪র্থ খন্ড, ২৫৫ পৃষ্ঠা; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, ১৬০ পৃষ্ঠা; আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭৪।] এর স্পষ্ট অর্থ এই ছিল যে, এটা ছিল নিছক একটি সামরিক কৌশল। কুরআনকে ফায়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করা আদৌ এর লক্ষ্য ছিল না।
পরামর্শ অনুযায়ী মুআবিয়া (রাঃ)-এর সৈন্যবাহিনী কুরআনকে বর্শার তুলে ধরে। এর ফলে হযরত ইবনুল আ’স (রাঃ) যা আশা করেছিলেন তাই হয়। হযরত আলি (রাঃ) ইরাকের লোকদেরকে হাজারো বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, তোমরা এ চক্রান্তে পড়ো না, যুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিলে দাও। কিন্তু তাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ করে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর সাথে তাহকীম-এর চুক্তি করতে হযরত আলি (রাঃ) বাধ্য হন। হাকাম বা সালিস নিযুক্ত করার সময়ও এ অনৈক্য দেখা দেয়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) তাঁর পক্ষ থেকে হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ)-কে হাকাম নিযুক্ত করেন। হযরত আলি (রাঃ)-এর ইচ্ছা ছিল, তাঁর পক্ষ থেকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে হাকাম নিযুক্ত করার। কিন্তু ইরাকের লোকেরা বলে উঠলো যে, তিনি তো আপনার চাচাত ভাই। আমরা নিরপেক্ষ লোক চাই। শেষ পর্যন্ত তাদের পীড়াপীড়িতে পড়ে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-কে হাকাম নিযুক্ত করতে বাধ্য হন। অথচ তাঁর ব্যাপারে তিনি নিজে নিশ্চিন্ত ছিলেন না। [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪, ৩৫, ৩৬; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬১, ১৬২; আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭৫, ২৭৬; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭৫।]
ষষ্ঠ পর্যায়—
এখন খেলাফতকে রাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখার সর্বশেষ সুযোগটি মাত্র অবশিষ্ট ছিল। তা ছিল-এই যে, যে চুক্তি অনুযায়ী সালিসদ্বয়কে ফায়সালা করার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল তারা যথাযথ ফায়সালা করবেন। চুক্তির যে, বিবরণী ঐতিহাসিকরা উদ্ধৃত করেছেন, তাতে ফায়সালার ভিত্তি ছিল এই— ‘উভয় সালিস আল্লাহর কিতাব অনুসারে কাজ করবেন আর আল্লার কিতাবে যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে না সে ব্যাপারে সত্যাশ্রয়ী এবং ঐক্য সংহতকারী সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করবো। [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮; আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭৬; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭৫।]
কিন্তু ‘দুমাতুল জান্দাল’-এ উভয় সালিস যখন বসেন, তখন কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে এ বিরোধের মীমাংসা হতে পারে এ বিষয়টি আদতে আলোচনার অন্তর্ভূক্ত হয়নি। কুরআনে সুষ্ঠু নির্দেশ রয়েছে যে, মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়লে বিরোধ মীমাংসার সঠিক উপায় হচ্ছে বিদ্রোহী দলকে সত্যপথে আসতে বাধ্য করা। [আল-হুজুরাতে ৯ আয়াত— “মুমিনদের দুটি দল যদি পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করো। একদল যদি অপর দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাহলে বিদ্রোহী দল আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো।” হযরত আম্মার-এর শাহাদাতের পর নবী করীম (সাঃ)-এর সুস্পষ্ট হাদীস দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছিল যে, এ বিরোধে বিদ্রোহী দল কোনটি। একজন আমীরের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর আনুগত্য অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধেও স্পষ্ট হাদীস বর্তমান ছিল। রক্তের প্রতিশোধ দাবী করারও স্পষ্ট বিধান বর্তমান ছিল শরীয়তে। এ বিধানের আলোকে বিচার করা যেতো যে, হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ)-এর খুন সম্পর্কে তাঁর দাবী সঠিক পন্থায় উত্থাপন করেছেন, না অন্যায় পন্থায়। সালিস চুক্তিতে উভয় সালিসের উপরে আসলে এ দায়িত্ব অর্পণই করা হয়নি যে, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছা মতো খেলাফত সম্পর্কে একটি ফায়সালা করে দেবেন। বরং তাদের সামনে উভয় পক্ষের বিরোধ দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরা হয় এবং প্রথমে আল্লার কিতাব অতঃপর রাসূলের ন্যায়ানুগ সুন্নতের ভিত্তিতে এর মীমাংসা করার দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়। কিন্তু উভয় বুযুর্গ যখন আলোচনা শুরু করেন তখন এ সমস্ত বিষয় বেমালুম ভুলে গিয়ে খেলাফতের ব্যাপারে কিভাবে একটা সমাধানে পৌঁছানো যায় এ নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে থাকেন।
হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, আপনার মতে এ ব্যাপারে কোন পন্থা সমীচীন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মত এই যে, আমরা এ ব্যক্তিদ্বয়কে (আলি এবং মুআবিয়া) বাদ দিয়ে খেলাফতের ব্যাপারটি মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের উপর ছেড়ে দেই, যাতে তারা যাকে খুশী নির্বাচিত করতে পারে।’
হযরত আমর (রাঃ) বললেন, 'আপনি যথার্থ চিন্তা করেছেন।'
অতপর উভয়ে এক গণসমাবেশে উপস্থিত হন। এ গণসমাবেশে উভয় পক্ষ থেকে ৪শত করে সমর্থক এবং কয়েকজন নিরপেক্ষ বুযুর্গও উপস্থিত ছিলেন। হযরত আমর (রাঃ) হযরত আবু মূসা (রাঃ)-কে বলেন, ‘আমাদের উভয়ের ঐক্যমতে পৌছার কথাটা আপনি এদেরকে বলে দিন।’ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত আবু মূসা (রাঃ)-কে বলেন, ‘আপনারা উভয়ে ঐক্যমতে উপনীত হয়ে থাকলে হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ)-কে তা ঘোষণা করতে দিন। কারণ আমার আশংকা হচ্ছে, আপনি প্রতারিত হয়েছেন।' হযরত আবু মূসা (রাঃ) বলেন, ‘আমি এ রকম কোন আশংকা করছি না। আমরা একমত হয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি।’ অতঃপর তিনি ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘আমি এবং আমার এ বন্ধু (অর্থাৎ আমর ইবনুল আ’স) একটি বিষয়ে একমত হয়েছি। তা এই যে, আমরা আলি (রাঃ) এবং মুআবিয়া (রাঃ)-কে বাদ দেবো, অতঃপর জনগণ পরামর্শক্রমে যাকে খুশী আমীর নিযুক্ত করবে। সুতরাং আমি আলি (রাঃ) এবং মুআবিয়া (রাঃ)-কে বরখাস্ত করছি। এখন নিজেদের ব্যাপার আপনারা নিজেদের হাতে নিয়ে নিন এবং যাকে যোগ্য মনে করেন, আমীর নিযুক্ত করুন।’
অতঃপর হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইনি যা বলেছেন, আপনারা শুনলেন। তিনি নিজের লোক (হযরত আলি)-কে বরখাস্ত করেছেন। তাঁর মতে আমিও তাঁকে বরখাস্ত করছি এবং আমার নিজের লোক (হযরত মুআবিয়াকে) বহাল রাখছি। কারণ তিনি ওসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-এর বন্ধু এবং তাঁর রক্তের দাবীদার। উপরন্তু তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।’
হযরত আবু মূসা (রাঃ) এ কথা শুনেই বলে ওঠেন— “তুমি এ কি করলে? আল্লাহ তোমাকে সুযোগ দেবেন না। তুমি প্রতারণা করেছো এবং চুক্তির বিরোধিতা করেছো।” হযরত সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন, 'আবু মূসা! তোমার জন্য আফসোস হয়। আমরের চক্রান্তের মুকাবিলায় তুমি অনেক দুর্বল প্রতিপন্ন হলে।’ হযরত আবু মূসা (রাঃ) জবাবে বলেন, 'এখন আমি কি করবো? তিনি আমার সাথে একটি বিষয় একমত হয়েছিলেন পরে তা থেকে মুক্ত করে নিলেন নিজেকে।’ হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবুবকর (রাঃ) বলেন, “এর পূর্বে আবু মূসা মারা গেলে তা তার জন্য অতি উত্তম হতো।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, ‘দেখো, এ উম্মতের অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। এমন দু ব্যক্তির ওপর উম্মতের ভবিষ্যত ন্যস্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে একজন কি করেছেন তার কোন পরওয়া করেন না, আর অন্যজন দুর্বল। [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫১; ইবনে সাআদ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২৫৬, ২৫৭; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৮; আল বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮২, ২৮৩; ইবনে খালদুন, ২য় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭৮।]
হযরত আবু মূসা (রাঃ) তাঁর ভাষণে যা বলেছিলেন, সে সম্পর্কে যে উভয়ের মধ্যে ঐক্যমত হয়েছিল-এ বিষয়ে সেখানে উপস্থিত কোন ব্যক্তির সন্দেহ ছিল না। হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) যা কিছু করেন, তা ছিল স্থিরকৃত সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতঃপর হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে খেলাফতের সুসংবাদ দেন। হযরত আবু মূসা (রাঃ) লজ্জায় হযরত আলি (রাঃ)-কে মুখ দেখাতে না পেরে সরাসরী মক্কা চলে যান। —[আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮৩; ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১৭৮।]
হাফেজ ইবনে কাসীর হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ)-এর এ কার্যের ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, তিনি জনগণকে সে মুহুর্তে নেতা বিহীন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া সমীচীন মনে করেননি। কারণ তখন জনগণের মধ্যে যে মতানৈক্য বিরাজ করছিল, তা দেখে তাঁর আশংকা হয় যে, এর ফলে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় দেখা দেবে। তাই, তিনি প্রয়োজনের তাগিদে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে বহাল রাখেন; ইজতিহাদ নির্ভুলও হয়, ভুলও হয়। —[আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮৩।]
কিন্তু যে কোন ইনসাফপ্রিয় ব্যক্তি বর্শার মাথায় কুরআন বাঁধার প্রস্তাব থেকে শুরু করে এ পর্যন্তকার সমস্ত বিবরণী পাঠ করবেন, এসব কিছুকে ‘ইজতিহাদ’ বলে মেনে নেয়া তার পক্ষে বড়ই কঠিন হয়ে পড়বে। সন্দেহ নেই, আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সকল সাহাবীই সম্মানার্হ। যে ব্যক্তি তাঁদের কোন ভুলের কারণে তাঁদের সকল খেদমত অস্বীকার করে বসে এবং তাঁদের উচ্চতর মর্যাদা বিস্মৃত হয়ে গালি দেয়ার পর্যায়ে নেমে আসে, সে সত্যিই শত-সহস্র বার জুলুম করে। কিন্তু তাঁদের কেউ কোন ভুল করলে নিছক সাহাবীদের মর্যাদার কারণে তাকে ‘ইজতিহাদ’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করাটাও কম জুলুম ও অন্যায় নয়। বড় লোকদের ভুল যদি তাদের মহত্বের ফলে ইজতিহাদ হয়ে যায়, তবে পরবর্তীকালের লোকদেরকে কি বলে এমন সব ইজতিহাদ থেকে আমরা নিবৃত্ত করবো? ইজতিহাদের অর্থই তো হচ্ছে সত্য বিষয় অবগত হওয়ার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা। এ চেষ্টা অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল হয়ে গেলেও সত্য জানার চেষ্টা অবশ্যি প্রতিদান লাভের অধিকারী হবে। কিন্তু জেনে শুনে সুপরিকল্পিত উপায়ে কোন ভুল করার নাম কিছুতেই ইজতিহাদ হতে পারে না। বস্তুত এ সকল ব্যাপারে বাড়াবাড়ি একান্তই বর্জনীয়। কোন ভুল কাজ নিছক সাহাবী হওয়ার ফলে মর্যাদাপূর্ণ হতে পারে না; বরং সাহাবীর মহান মর্যাদার ফলে সে ভুল আরও উৎকট হয়ে ওঠে। তবে সে ব্যাপারে মন্তব্যকারীকে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভুলকে ভুল মনে করা এবং ভুল বলা পর্যন্তই মন্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। আরও অগ্রসর হয়ে সাহাবীদের ব্যক্তিসত্ত্বাকে সামগ্রিকভাবে অভিযুক্ত ও দোষারোপ করা যাবে না। নিঃসন্দেহে হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) বিরাট মর্যাদা সম্পন্ন বুযুর্গ। তিনি ইসলামের বহু মূল্যবান খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ দুটি ভুল কাজ করেছেন, যাকে ভুল না বলে গত্যন্তর নেই।
উভয় সালিসের মধ্যে কে কি করেছেন, সে আলোচনার প্রবৃত্ত না হয়েও এ কথা বলা চলে যে, দুমাতুল জানদালে যা কিছু ঘটেছে, তার সবটুকুই ছিল সালিসী চুক্তির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এভাবে নিঃসন্দেহে চুক্তির সীমালংঘন করা হয়েছিল। তাঁরা অন্যায়ভাবে এ কথা ধরে নিয়েছিলেন যে, হযরত আলি (রাঃ)-কে বরখাস্ত করার ইখতিয়ার তাঁদের রয়েছে। অথচ হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর তিনি যথারীতি আইনানুগ পন্থায় খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সালিসী চুক্তির কোন শব্দের এমন অর্থ করা যায় না, যা থেকে বুঝা যায় যে, তাঁকে বরখাস্ত করার ইখতিয়ার তাদেরকে দেয়া হয়েছে। উপরন্তু তাঁরা এ কথাও অন্যায়ভাবে ধরে নিয়েছেন যে, হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হযরত আলি (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে খেলাফতের দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। অথচ এ পর্যন্ত তিনি কেবল মাত্র হযরত ওসমান (রাঃ)-এর রক্তের দাবীদার ছিলেন, খেলাফতের দাবীদার ছিলেন না। সর্বোপরি তাদের এ ধারণাও ভুল ছিল যে, তাদেরকে খেলাফত সমস্যার সমাধানের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। সালিসী চুক্তিতে এহেন ভ্রান্ত ধারণার কোন ভিত্তি ছিল না। এ কারণে হযরত আলি (রাঃ) তাঁদের ফায়সালা প্রত্যাখ্যান করেন এবং এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘শোন! তোমরা যে দুজনকে সালিস নিযুক্ত করেছিলে, তারা কুরআনের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকেই তাদের সকলেই স্ব স্ব ধারণার অনুসরণ করেছে। তারা এমন ফায়সালা দিয়েছে, যা সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ এবং অতীত রীতির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এ ফায়সালায় তাদের কেউই একমত হতে পারেনি। কেউই পারেনি কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। —[তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৭।]
অতঃপর হযরত আলি (রাঃ) কুফায় পৌঁছে পুনরায় শ্যাম আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেন। এ সময় তিনি যেসব ভাষণ দেন, তা থেকে স্পষ্ট জানা যায়, তিনি মিল্লাতের ওপর স্বৈরতন্ত্র আরোপিতা হওয়ার আশংকা কতো তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন এবং খেলাফতে রাশেদার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এক ভাষণে তিনি বলেন, 'আল্লার শপথ, এরা যদি তোমাদের শাসক হয়ে বসে, তাহলে তোমাদেরকে কাইজার এবং হেরাক্লিয়াসের ন্যায় শাসন করতে থাকবে। —[ আত-তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৮; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭১।]
অপর এক ভাষণে তিনি বলেন, 'যারা আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজেদের গোলাপে পরিণত করার জন্য এবং স্বৈরাচারী শাসক হবার জন্য তোমাদের সাথে লড়ছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তোমরা প্রস্তুত হও।' [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৯; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭২।]
কিন্তু ইরাকের লোকেরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল এবং অন্যদিকে খারেজিদের বিপর্যয় হযরত আলি (রাঃ)-এর জন্য এক নতুন মাথা ব্যাথার সৃষ্টি করে। এ ছাড়া হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এবং হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) এমন কৌশল অবলম্বন করেন, যার ফলে মিসর এবং উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ অঞ্চলও তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায় এবং মুসলিম জাহান কার্যত দুটি সংঘর্ষশীল সরকারে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে হযরত আলি (রাঃ)-এর শাহাদাত (৪০ হিজরী) রমজান মাসের এবং হযরত হাসান (রাঃ)-এর সমঝোতা (৪১ হিজরী) ময়দানকে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা দেখে যেসব লোক ইতিপূর্বে হযরত আলি (রাঃ) এবং তাঁর বিরোধীদের মধ্যকার যুদ্ধকে নিছক ফেতনা বলে উল্লেখ করে নির্লিপ্ত ছিলেন, তাঁরাও ভালভাবে বুঝতে সক্ষম হন যে, হযরত আলি (রাঃ) কোন বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং উম্মতকে কোন পরিণতি থেকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে আসছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁর জীবনের শেষ সময়ে বলেছিলেন, ‘আমি আলি (রাঃ)-এর সঙ্গে কেন যোগ দেইনি, এ জন্য যত অনুতাপ হয়েছে, তা আর কিছুর জন্য হয়নি।’ [ইবনে সাআদ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৮৭; ইবনে আবদুল বার, আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩০-৩৭।]
ইবরাহীম নাখঈর বর্ণনায়; ‘মাসরুক ইবনে আজদা’ হযরত আলি (রাঃ)-এর সাথে যোগ না দেয়ার জন্য তাওবা ও এস্তেগফার করেন। [আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩০।]
হযরত আলি (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ অবলম্বন করার জন্য হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) সারা জীবন ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত ছিলেন। [আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৭১।]
হযরত আলি (রাঃ) এ বিপর্যয়কালে যেভাবে কাজ করেছেন, তা একজন খলীফায়ে রাশেদের সম্পূর্ণ উপযোগী ছিল। কেবল একটি বিষয়ে এমন দেখা যায়, যার সমর্থন করা অত্যন্ত কঠিন মনে হয়। তা হচ্ছে, যুদ্ধের পর হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের ব্যাপারে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করেন। জামাল যুদ্ধের পূর্বপর্যন্ত তিনি তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে সহ্য করতেন, তাদেরকে কাবু করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং হযরত তালহা (রাঃ) ও যুবায়ের (রাঃ)-এর সাথে আলাপ আলোচনার জন্য তিনি যখন হযরত কা’কা’ ইবনে আমরকে প্রেরণ করেন, তখন তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে কা’কা’ বলেছিলেনঃ ‘হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হন্তাদের পাকড়াও করার ক্ষমতালাভের পূর্ব পর্যন্ত হযরত আলি (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে হস্ত উত্তোলন থেকে বিরত রয়েছেন। আপনারা বায়াত গ্রহণ করলে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর খুনের প্রতিশোধ গ্রহণ সহজ হয়ে যাবে। [আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৩৭।]
অতঃপর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে হযরত তালহা (রাঃ) এবং যুবায়ের (রাঃ)-এর সাথে তাঁর কথাবার্তা হয়েছে। তাতে হযরত তালহা (রাঃ) তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, আপনি ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার জন্য দায়ী। জবাবে তিনি বলেন, 'ওসমান হন্তাদের ওপর আল্লার অভিসম্পাত।' [আল-বেদায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪০।] কিন্তু হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে অবশেষে তাঁকে হত্যার জন্য যারা দায়ী, অতঃপর এবং মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর (রাঃ)-কে গবর্ণর পদে নিয়োগ করেন। অথচ ওসমান (রাঃ)-এর হত্যায় এদের যে ভূমিকা ছিল, তা সকলেরই জানা। হযরত আলি (রাঃ)-এর সমগ্র খেলাফত আমলে এ একটি কাজই আমরা এমন দেখতে পাই, যাকে ভুল না বলে উপায় নেই।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মতো হযরত আলি (রাঃ)-ও তাঁর অনেক আত্মীয়-স্বজনকে বড় বড় পদে নিয়োগ করেছেন। যেমন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত কোসাম ইবনে আব্বাস (রাঃ) ইত্যাদি। কিন্তু এ যুক্তি পেশ করার সময় তারা ভুলে যান যে, হযরত আলি (রাঃ) এমন এক পরিস্থিতিতে এ কাজ করেছিলেন, যখন উন্নতমানের যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একটি অংশ তাঁর সাথে সহযোগিতা করছিল না, অন্যদিকে অপর একটি অংশ বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়েছিল এবং তৃতীয় অংশটি থেকেও প্রতিদিন লোকেরা বের হয়ে ভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে তিনি এমন সব লোককে কাজে লাগাতে বাধ্য হন, যাদের ওপর তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর আমলের পরিস্থিতির সাথে এ পরিস্থিতির কোন মিল নেই। কারণ তিনি এমন এক সময় এ কাজ করেন, যখন উম্মাতের সমস্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির সম্পূর্ণ সহযোগিতা তিনি লাভ করেন। আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণে তিনি বাধ্য ছিলেন না।
শেষ পর্যায়—
ক্ষমতার চাবিকাটি মুআবিয়া (রাঃ)-এর হস্তগত হওয়াই ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফত থেকে স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের দিকে প্রত্যাবর্তনের অন্তবর্তীকালীন পর্যায়। দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিরা এ পর্যায়েই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, এখন তারা রাজতন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্মুখীন। তাই দেখি, হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর বায়আতের পর হযরত সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে— রাজা! আপনার প্রতি সালাম বলে সম্বোধন করেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেন, আপনি আমীরুল মুমিনীন বললে কি অসুবিধা ছিল? জবাবে তিনি বলেন, আল্লার কসম, যে পন্থায় আপনি ক্ষমতা লাভ করেছেন, আমি সে পন্থায় কিছুতেই তা গ্রহণ করতাম না। [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪০৫; এ ব্যাপারে হযরত সাআদ (রাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গী কি ছিল, একটি ঘটনা থেকে তার ওপর আলোকপাত হয়। বিপর্যয় কালে একদা তাঁর ভ্রাতুষপুত্র হাশেম ইবনে ওতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস তাঁকে বলেন, আপনি খেলাফতের জন্য দাঁড়ালে অসংখ্য তরবারী আপনার সমর্থনের জন্য প্রস্তুত। জবাবে তিনি বলেন, এসব লক্ষ তরবারীর মধ্যে আমি কেবল একখানা তরবারী চাই, যা কাফেরের ওপর চলবে, চলবে না কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে (আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭২)।]
হযরত মুআবিয়া (রাঃ) নিজেও এ'কথা জানতেন। একবার তিনি নিজেই বলেছিলেন, 'আমি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম রাজা।' [আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৫; আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৫।] বরং হাফেজ ইবনে কাসীর-এর উক্তি অনুযায়ী তাঁকে খলীফা না বলে বাদশাহ বলাই সুন্নত। কারণ, মহানবী (সঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আমার পর খেলাফত ৩০ বৎসর থাকবে, অতঃপর বাদশাহীর আগমন হবে।’ হিজরী ৪১ সালের রবিউল আউয়াল মাসে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষে হযরত হাসান (রাঃ)-এর খেলাফত ত্যাগের মাধ্যমে এ মেয়াদ সমাপ্ত হয়েছে। —[আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬।]
এখন খেলাফত আল মিনহাজিন নবুয়াত (মহানবী প্রদর্শিত পথে খেলাফত) বহাল করার একটি মাত্র উপায়ই অবশিষ্ট ছিল, তা ছিল হযরত মুআবিয়া (রাঃ) তাঁর অবর্তমানে কাউকে এ পদে নিয়োগ করার ভার মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের ওপর ছেড়ে দিতেন; অথবা বিরোধ নিরসনের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবদ্দশায়ই স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারটি চূড়ান্ত করা প্রয়োজনীয় মনে করলে মুসলমানদের সৎ ও ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমবেত করে উম্মতের মধ্য থেকে যোগ্যতম ব্যক্তিকে বাছাই করার স্বাধীনতা ক্ষমতা দান করতেন। কিন্তু স্বীয় পুত্র ইয়াজীদের স্বপক্ষে ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসা দেখিয়ে বায়আত গ্রহণ করে তিনি এ সম্ভাবনারও সমাপ্তি ঘটালেন।
হযরত মুগীরা ইবনে শো’বা (রাঃ) এ প্রস্তাবের উদ্ভাবক। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) তাঁকে কুফার গবর্ণরে পদ থেকে বরখাস্ত করার কথা চিন্তা করছিলেন; তিনি এ বিষয়ে অবহিত হলেন। তৎক্ষণাৎ কুফা থেকে দামেশকে পৌছে ইয়াজিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন, ‘শীর্ষ স্থানীয় সাহাবী এবং কুরাইশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমি বুঝতে পারছি না আমীরুল মুমিনীন তোমার পক্ষে বায়আত গ্রহণের কেন বিলম্ব করছেন।’ ইয়াজীদ তাঁর পিতার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি হযরত মুগীরা (রাঃ)-কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ইয়াজিদকে কি বলেছো? হযরত মুগীরা (রাঃ) জবাব দেন, ‘আমিরুল মুমিনীন! হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার পর যতো মতবিরোধ এবং খুন-খারাবী হয়েছে, তা আপনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। কাজেই এখন আপনার জীবদ্দশায়ই ইয়াজীদকে স্থলাভিষিক্ত করে বায়আত গ্রহণ করাই আপনার জন্য উত্তম। ফলে আল্লাহ না করুন যদি আপনার কখনো কিছু হয়ে যায়, তাহলে অন্তত মতবিরোধ দেখা দেবে না।’ হযরত মুআবিয়া (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব কে নেবে?' জবাবে তিনি বললেন, আমি কুফারবাসীদের সামলাবো; আর যিয়াদ বসরাবাসীদেরকে। এরপর বিরোধিতা করার আর কেউ থাকবে না।’
এ কথা বলে হযরত মুগীরা (রাঃ) কুফা গমন করেন এবং দশজন লোককে ৩০ হাজার দেরহাম দিয়ে একটি প্রতিনিধি দলের আকারে হযরত মুআবিয়ার নিকট গমন করে ইয়াজীদের স্থলাভিষিক্তের জন্য তাঁকে বলতে সম্মত করেন। হযরত মুগীরা (রাঃ)-এর পুত্র মুসা ইবনে মুগীরার নেতৃত্বে এ প্রতিনিধি দল দামেস্কে গমন করে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে। পরে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) মুসাকে একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার পিতা এদের নিকট থেকে কত মূল্যে এদের ধর্ম ক্রয় করেছেন?' তিনি বললেন, '৩০ হাযার দিরহামের বিনিময়ে।' হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেন, 'তাহলে তো এদের ধর্ম এদের দৃষ্টিতে নিতান্ত নগন্য।' [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৯; আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭৯ এবং ইবনে খালদুন, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫-১৬ তে এঘটনার অংশ বিশেষের উল্লেখ আছে।]
অতঃপর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বসরার গবর্ণর যিয়াদকে লিখেন, এ ব্যাপারে তোমার মত কি? তিনি ওবায়েদ ইবনে কাআব আন নুমাইরকে ডেকে বলেন, আমিরুল মুমিনীন এ ব্যাপারে আমাকে লিখেছেন। আমার মতে ইয়াজীদের মধ্যে অনেকগুলো দুর্বলতা রয়েছে। তিনি দুর্বলতাগুলো উল্লেখ করেন। অতঃপর বলেন, তুমি আমীরুল মুমিনীনের কাছে গিয়ে বলো যে, এ ব্যাপারে যেন তাড়াহুড়ো না করা হয়। ওবায়েদ বলেন, আপনি হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর মতামত নষ্ট করার চেষ্টা করবেন না। আমি গিয়ে ইয়াজীদকে বলবো যে, আমীরুল মুমিনীন এ ব্যাপারে আমীর যিয়াদের পরামর্শ চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, জনগণ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে। কারণ, তোমার কোন কোন আচার-আচরণ জনগণ পসন্দ করে না। তাই আমীর যিয়াদের পরামর্শ এই যে, তুমি এ সব বিষয় সংশোধন করে নাও, যাতে কাজটি ঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে। যিয়াদ এ মত পসন্দ করেন। ওবায়েদ দামেস্ক গমন করে এক দিকে ইয়াজীদকে তাঁর ব্যক্তিগত আচার-আচরণ সংশোধনের পরামর্শ দেন, আর অপর দিকে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-কে বলেন, আপনি এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবেন না। [আত-তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৪, ২২৫; ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৯-২৫০; আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭৯।] ঐতিহাসিকরা বলেন, এরপর ইয়াজীদ তাঁর বহু আচরণ সংশোধন করে নেন, যা লোকেরা আপত্তিকর মনে করতো। কিন্তু এ বিবরণ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। এক). ইয়াজীদের স্থলাভিষিক্তের প্রাথমিক আন্দোলন কোন সুষ্ঠু ভাবধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না; বরং একজন বুযুর্গব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থে অপর বুযুর্গের স্বার্থকে চাঙ্গা করে এ প্রস্তাবের জন্ম দিয়েছিলেন। এভাবে তাঁরা উম্মাতে মুহাম্মদীকে কোন পথে ঠেলে দিচ্ছেন, তা কোন বুযুর্গই চিন্তা করেননি। দুই). ইয়াজীদ নিজে এমন মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন না যে মুআবিয়া (রাঃ)-এর পুত্র হবার বিষয়টি বাদ দিলে কেউ এ কথা বলতে পারেন যে, হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এর পরে উম্মতের নেতৃত্বের জন্য তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন।
যিয়াদের মৃত্যুর (৫০ হিজরী) পর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) ইয়াজীদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রভাবশালী লোকদের সমর্থন লাভের চেষ্টা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর নিকট এক লক্ষ দেরহাম পাঠিয়ে ইয়াজীদের বায়আতের জন্য তাঁকে সম্মত করাবার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘ওহো, এ উদ্দেশ্যে আমার জন্য এ টাকা পাঠান হয়েছে। তা হলে তো আমার দ্বীন আমার জন্য খুবই সস্তা।’ এ বলে তিনি টাকা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫০; আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮৯।]
এরপর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) মদীনার গভর্ণর মারওয়ান ইবনুল হাকামকে লিখেন, ‘আমি বৃদ্ধ হয়ে পড়িছি, আমার জীবদ্দশায়ই কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতে চাই। ………….স্থলাভিষিক্ত মনোনয়নের ব্যাপারে জনগণের মতামত জিজ্ঞেস করো।’ মারওয়ান বিষয়টি মদীনাবাসীদের সামনে উত্থাপন করেন। সকলেই বলেন, এটা একান্ত অসমীচীন। এরপর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) আবার মারওয়ানকে লিখেন, ‘আমি স্থলাভিষিক্তির জন্য ইয়াজীদকে মনোনীত করেছি।’ মারওয়ান পুনরায় বিষয়টি মদীনাবাসীদের সামনে উত্থাপন করে মসজিদে নববীতে ভাষণ দান করেন। তিনি বলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন তোমাদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি সন্ধান করার ব্যাপারে কোন ত্রুটি করেননি। তিনি নিজে পুত্র ইয়াজীদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এটা একটা চমৎকার সিদ্ধান্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি নিজ পুত্রকে স্থলাভিষিক্ত করেছেন, এটা কোন নতুন কথা নয়। আবুবকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ)-ও স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেছিলেন।’ এতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবুবকর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মারওয়ান! তুমি মিথ্যা বলেছো। আর মিথ্যা বলেছে মুআবিয়াও। তোমরা কখনো উম্মাতে মুহাম্মদীয়ার কল্যাণের কথা চিন্তা করোনি। তোমরা একে ‘কায়সরতন্ত্রে’ রূপান্তিরত করতে চাও। একজন কায়সর মারা গেলে তার পুত্র তার স্থান দখল করে। এটা আবুবকর ও ওমরের নীতি নয়। তাঁরা আপন সন্তানকে স্থলাভিষিক্ত করেননি।’ মারওয়ান বলেন, 'ধরো একে’। এ ব্যক্তি সম্পর্কেই তো কুরআনে বলা হয়েছে— "যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে বলেছে, দুঃখ তোমাদের জন্য।"
হযরত আবুদর রহমান (রাঃ) পলায়ন করে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর হুজরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) চীৎকার করে বলেন, ‘মিথ্যা বলেছে মারওয়ান। আমাদের খান্দানের কারো প্রসঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। বরং যার প্রসঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, আমি ইচ্ছা করলে তার নাম বলতে পারি। অবশ্য মারওয়ান যখন পিতার ঔরসে, তখন রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাঁর পিতার ওপর লানৎ বর্ষণ করেন।’ মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবুবকর (রাঃ)-এর মতো হযরত হুসাইন ইবনে আলি (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ)-ও ইয়াজীদের স্থলাভিষিক্ততা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। [বুখারী শরীফে সুরায়ে আহকাফের তাফসীরে এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। হাফেজ ইবনে হাজার ফতহুল বারীতে নাসায়ী, ইসমাঈলী, ইবনুল মুনযের, আবু ইয়া’লা এবং ইবনে আবী হাতেম হতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। হাফেয ইবনে কাসীরও তাঁর তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম এবং নাসায়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে এর আনুসাঙ্গিক বিবরণ উল্লেখ করেছেন। আরও বিস্তারিত বিবরণের জন্য আল-ইস্তীআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৯৩; আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮৯ এবং ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫০ দেখুন। ইবনুল আসীর লিখেছেন, কোন কোন বর্ণনা মতে হিজরী ৫৩ সালে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবুবকর ইন্তেকাল করেন। এটা সত্য হলে তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন না।’ কিন্তু নির্ভরযোগ্য হাদীসের বর্ণনা এর বিপক্ষে। হাফেজ ইবনে কাসীর আল-বেদায়ায় লিখেছেন, হিজরী ৫৮ সালে তার ইন্তেকাল হয়েছে।]
এ সময়ে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের তলব করে বিষয়টি তাদের সামনে উত্থাপন করেন। জবাবে সকলেই তোষামোদমূলক বক্তব্য পেশ করে। কিন্তু হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস নীরব থাকেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আবু, বাহর, তোমার কি মত?’ তিনি বলেন, ‘সত্য বললে আপনার ভয়, আর মিথ্যা বললে আল্লাহর ভয়। আমীরুল মুমিনীন, আপনি ইয়াজীদের দিন-রাত্রির চলাফেরা ওঠা-বসা, তার ভিতর-বাহির সবকিছু সম্পর্কে ভালভাবেই জানেন। আল্লাহ এবং এ উম্মতের জন্য সত্যিই তাকে পসন্দ করে থাকলে এ ব্যাপারে আর কারো পরামর্শ নেবেন না। আর যদি তাকে এর বিপরীত মনে করে থাকেন, তাহলে আখেরাতের পথে পাড়ি দেবার আগে দুনিয়া তার হাতে দিয়ে যাবেন না। আর বাকী রইলো আমাদের ব্যাপার; যা কিছু নির্দেশ দেয়া হয়, তা শোনা এবং মেনে নেয়াইতো আমাদের কাজ।’ —[,ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫০-২৫১। আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮০।]
ইরাক, শ্যাম এবং অন্যান্য এলাকা থেকে বায়আত গ্রহণ করে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হেজাজ গমন করেন; কারণ, হেজাজের ব্যাপারটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম জাহানের যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিরোধিতার আশংকা ছিল, তাঁরা সকলেই ছিলেন সেখানে। মদীনার বাইরে থেকে হযরত হুসাইন (রাঃ), হযরত ইবনে যুবায়ের (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবুবকর (রাঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) তাদের সাথে এমন কঠোর আচরণ করেন যে, তাঁরা শহর ত্যাগ করে মক্কা চলে যান। এভাবে মদীনার ব্যাপারটি সহজ হয়ে যায়। এরপর তিনি মক্কা গমন করে ব্যক্তি চতুষ্টয়কে শহরের বাইরে ডেকে এনে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। মদীনার অদুরে তাঁদের সাথে যে আচরণ করেছিলেন এবারের আচরণ ছিল তা থেকে ভিন্ন। তাদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করেন, তাঁদেরকে সাথে করে শহরে প্রবেশ করেন। অতঃপর তাঁদেরকে একান্তে ডেকে ইয়াজীদের বায়আতে তাদেরকে রাযী করাবার চেষ্টা করেন। হযরত আবুদল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) জবাবে বলেন, ‘আপনি তিনটি কাজের যে কোন একটি করুন। হয় নবী করীম (সঃ)-এর মতো কাউকে স্থলাভিষিক্ত-ই করবেন না, জনগণ নিজেরাই কাউকে খলীফা বানাবে, যেমন বানিয়েছিল হযরত আবুবকর (রাঃ)-কে। অথবা আবুবকর (রাঃ) যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন সে পন্থা অবলম্বন করুন। তিনি স্থলাভিষিক্তের জন্য হযরত ওমর (রাঃ)-এর মতো ব্যক্তিকে মনোনীত করেছিলেন, যাঁর সাথে তাঁর দুরতম কোন আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল না। অথবা হযরত ওমর (রাঃ)-এর পন্থা অবলম্বন করুন। তিনি ৬ ব্যক্তির পরামর্শ সভার প্রস্তাব দেন। এ পরামর্শ সভায় তাঁর সন্তানদের কেউ ছিলেন না।’
হযরত মুআবিয়া (রাঃ) অবশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা কি বলেন?’ তাঁরা বলেন, ‘ইবনে যুবায়ের (রাঃ) যা বলেছেন, আমাদের বক্তব্যও তাই।’ এরপর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেন, এতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে এসেছি। এবার আমি আল্লার কসম করে বলছি, ‘আমার কথার জবাবে তোমাদের কেউ যদি একটি কথাও বলে, তাবে তার মুখ থেকে পরবর্তী শব্দটি প্রকাশ করার অবকাশ দেয়া হবে না। সবার আগে তার মাথায় তরবারী পড়বে।’ অতঃপর তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান কর্মকর্তাকে ডেকে নির্দেশ দেন, ‘এদের প্রত্যেকের জন্য একজন লোক নিয়োগ করে তাকে বলে দাও যে, এদের কেউ আমার মতের পক্ষে বা বিপক্ষে মুখ খুললে তার মস্তক যেন উড়িয়ে দেয়া হয়।’ তারপর তিনি তাঁদেরকে নিয়ে মসজিদে গমন করে ঘোষণা করেন, ‘এরা মুসলমানদের স্থলাভিষিক্তে সন্তুষ্ট এবং এঁরা বায়আত (আনুগত্যের শপথ) করেছেন। সুতরাং তোমরাও বায়আত করো।' এক্ষেত্রে লোকদের পক্ষে অস্বীকার করার কোন প্রশ্নই ছিল না; কাজেই মক্কাবাসীরও সবাই বায়আত করে। [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫২।]
এমনি করে খেলাফতে রাশেদার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। খেলাফতের স্থান দখল করে রাজকীয় বংশধারা; প্রতিষ্ঠা হয় রাজতন্ত্র। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম জনতার ভাগ্যে ইপ্সিত খেলাফত আর কোন দিনও জোটেনি। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) যথার্থই বিপুল গুণের অধিকারী ছিলেন; তাঁর সাহাবী হওয়ার মর্যাদাও সম্মানার্থ; তিনি মুসিলিম জাহানকে পুনরায় এক পতাকাতলে সমবেত করেছেন এবং বিশ্বে ইসলামের বিজয়ের গতি পূর্বের চাইতেও দ্রুত করেছেন; তাঁর এসব খেদমত অনস্বীকার্য। যে ব্যক্তি তাঁকে গালাগালি করে, সে নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু, তাঁর অন্যায় কাজকে অন্যায়ই বলতে হবে; তাঁর অন্যায় কাজকে ন্যায় বলার অর্থ হবে, ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডকে আশংকার মুখে ঠেলে দেয়া। তবে, স্পর্ষকাতর এসব বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করা আবশ্যক।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২.