বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কিছু কথা :


কুপি-হারিকেনের আলোতে লেখাপড়া শিখা মানুষ ভাইরালের জামানায় উপনীত হয়ে কত কি যে দেখলাম আর দেখছি শিখলাম আর শিখছি তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না! ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ)-এর বিখ্যাত কিতাব আল-ফিকহুল আকবর-এর হার্ডকপি আমার কাছে আছে; এ'টা মূলতঃ আকিদার কিতাব। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জন্য অন্যন্য ও অদ্বিতীয় একটি  আকিদার কিতাব; ঈমানের মূল দিকনির্দেশনা। অনলাইনে এর পিডিএফ কপি খুঁজতে যেয়ে পড়লাম এক মহা বিপদে! সার্চ দিতেই গুগল যে ফিকহুল আকবর লিঙ্ক সাপ্লাই দিল তা দেখে আমি হতবাক! এ'টা এতো বড় কেন? ইমামে আজমের ৪৯ ধারা গেল কই?? যে বইটা অনুবাদ করেছে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, সে বইটা পড়ার পর জেনে বুঝেই মন্তব্য করছি— ঈমানদারকে বেইমান করার জন্য বইটি তৈরী করা হয়েছে, এবং ইমামে আজমের নাম ব্যবহার করে কূটচালে বাংলাভাষী মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে এতো ব্যাপকভাবে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। 

আমি যে অনুবাদ খুঁজছি তা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান অনুদিত ও সম্পাদিত 'আল-ফিকহুল আকবর'। যে বইয়ের সাথে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বইয়ের কোন মিল নেই; বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে দেখুন। দশবারের চেষ্টায়ও আসল বই পেলাম না, বারবার গুগল ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর কতৃক সম্পাদিত বইটিই দিল। অবশেষে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বইটিই ডাউনলোড করে এটার পরিসর দেখে অবাক হলাম; এটি একটি বিশাল বই। বইটি ডাউনলোড করে বেশ কয়দিন লাগিয়ে পড়লাম। এ বইটিতে মূলতঃ ইমামে আজমের প্রতি অবিশ্বাসের তীর ছোড়া হয়েছে; নিশ্চিত একটি জঘন্য কাজ, প্রতারণা! ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ)-র নাম করে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর যে অকাজ-আকাম করে গেছে এবং পৃথিবীতে স্বাক্ষী রেখে গেছে, যা হাজার হাজার মানুষকে পথভ্রষ্টতার অতলে তলিয়ে দিচ্ছে; নিশ্চয় তার প্রতিদান সে ওপারে পাচ্ছে। 

খোঁজ নিয়ে জানতে পাড়লাম মৃত্যুর পর অনলাইন বাজারে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর প্রচণ্ড রকমের ভাইরাল! কিন্তু ওপারে তিনি কেমন আছেন? হায়রে মুসলমান! মরে নেন, সবই টের পাবেন! আসল আর নকল না দেখে না চিনে না বুঝে জাহান্নামের রসদ আর কত কিনবেন? ভাইরাল মিজান, মামুনুল, ত্বহা....  তারপর কে এবং কি?? ইসলামের নামে তথাকথিত আলেমদের এসব ভণ্ডামি আর কত? ভণ্ডামিপূর্ণ এসব কর্মকাণ্ডে পুরো জাতি আজ হতবাক হতভম্ব! তারপরও মুসলমানের জ্ঞানোদয় হয় না, হবে না; কারণ সেই একই— অন্ধত্ব। মুসলমান যতদিন পর্যন্ত 'ইকরা' বা পড়ায় অভ্যস্ত না হবে, ততদিন এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না।

'রব্বুল আ’লামীন সর্ব প্রথম কি সৃষ্টি করেছেন?'— এ প্রশ্নটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজে; কারণ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর নামের এই তথাকথিত আলেমই উস্কে দিয়ে গেছে ইস্যুটিকে। তার মতো আলেমরাই সৃষ্টি করে গেছে জগতে এতো মতপার্থক্য। 'সর্বপ্রথম সৃষ্টি  কি কলম, না কি নূরে মুহাম্মাদী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম?'— এ নিয়ে বর্তমান মুসলমানরা পুরাপুরি দুইভাবে বিভক্ত। এমন কেন? আমার গবেষণা বলছে— যারা মনে করে প্রথম সৃষ্টি কলম, তাদের চোখে নিশ্চিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদ্বেষী একটি পর্দা আছে। এ কথায় হয়তো অনেকে রাগ করবেন বা করতে পারেন। দুঃখিত! এক কথায় এর চেয়ে আর ভালো কিছু লিখতে পারলাম না। তারপরও আপনাদের অনুরোধ করবো লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে।  

হযরত উবাইদা ইবনে ছামিত (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত; 'নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কলমকে বললেন, লিখ। কলম বললঃ হে প্রভূ! কি লিখবো? আল্লাহ বললেনঃ লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।' 
হাদিসটি যেসব কিতাবে উল্লেখ আছে— মুসনাদে আবু দাউদ তায়লাসী : হাদিস নং— ৫৭৮; মুসনাদে ইবনে জা’দ : হাদিস নং— ৩৪৪৪; মুসনাদে আহমদ : হাদিস নং— ২২৭০৭; তিরমিযী শরীফ : হাদিস নং — ২১৫৫; মান : সনদ সহীহ।

উক্ত হাদিসের প্রথম অংশ দ্বারা বুঝা যায় 'কলম' প্রথম সৃষ্টি। কিন্তু শেষ অংশটি দ্বারা কি বুঝা যায়?  নিশ্চয় 'কলম' প্রথম সৃষ্টি নয়; কারণ হাদিসটির শেষ অংশে রয়েছে 'আল্লাহ তা'আলা বললেন, 'লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।' যা দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যায়, কলম সৃষ্টির পূর্বেও অনেক কিছু ছিল; কারণ, আরবি এবারতে 'মা কানা' আছে, যা দ্বারা অতীতকালের ঘটনা বুঝায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় 'কলম'-কে প্রথম সৃষ্টি বলা হয়েছে কলমের সম্মানার্থে; মূলত প্রথম সৃষ্টি ‘কলম’ নয়। আমাদের দেশের কিছু আলেম আছে যারা হাদিসের শেষের অংশ বাদ দিয়ে শুধু প্রথম অংশ বর্ণনা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, এবং বলে— দেখ প্রথম সৃষ্টি কলম! অথচ হাদিসের পরের অংশ পড়লেই বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি কলম নয়; অন্য কিছু। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্তবা, শা'ন-মান ও মু'জেজা সম্পর্কিত যে কোন হাদিস আলবানী মেশিনে ফেলে আজকাল একদল জাল/জয়ীফ বলছে; ওই মেশিনে পড়লেই যে কোন হাদিস জাল/জয়িফ হয়ে যায়; কোন সনদের প্রয়োজন পড়ে না! এই মেশিনের স্রষ্টা নাসিরুদ্দিন আলবানীকে আমাদের দেশের মানুষ তেমন একটা ভালো চিনে-জানে না, কিন্তু এক্সিডেন্টে মৃত তথাকথিত বিশিষ্ট আলেম ফেসবুক/ইউটিউব মাওলানা মরেও যে অনবরত জগতে ঘুরছে, সেই ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার বিতর্কিত কিতাব— 'হাদীসের নামে জালিয়াতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিষয়ক জাল হাদীস'-এ নূরে মুহাম্মাদীই (সাঃ) প্রথম সৃষ্টি নয় বলে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করেছেন, তা পড়ে ও জেনে-বুঝে এ দেশের মুসলমান আজ গোমড়াহীতে ডুবে যাচ্ছে। অথচ পূর্ববর্তী বিখ্যাত সব আলেম এ হাদিসটি সহীহ্ বলেছেন; যা পরে তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ। একজন মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কলম ধরেছি শুধুমাত্র ঈমানি দায় থেকে। ইমামে আজমের ফিকার কিতাব 'ফিকাহুল আকবর'কে তিনি বিকৃত করেছেন এবং 'হাদিসের নামে জালিয়াতি' বলে মুসলিম সমাজকে খণ্ডিত করেছেন, তাই তার বিরুদ্ধে আজকের কলম ধরা। 

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের লেখা অনলাইন কিতাব থেকে কিয়দংশ আমি হুবহু তুলে ধরছি — "নূর মুহাম্মাদী প্রথম সৃষ্টি" অর্থে নিম্নের হাদীসটি সমাজে বহুল প্রচলিত:

أّوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِيْ

‘‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন’’। সুদীর্ঘ হাদীসটির সার সংক্ষেপ হলো, জাবির (রা) রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেন:

أوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرَ نَبِيِّك مِنْ نُوْرِهِ....

‘‘সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন।’’ এরপর এ লম্বা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা থেকে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।....

এ হাদীসটির অর্থ ইতোপূর্বে উদ্ধৃত সহীহ মুসলিমের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, তাতে বলা হয়েছে: ফিরিশতাগণ নূর থেকে, জিনগণ আগুন থেকে এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। আর এ হাদীসে বলা হচ্ছে যে, ফিরিশতা, জিন, ইনসান ও মহাবিশ্বের সব কিছুই নূর থেকে সৃষ্ট। তারপরও এ হাদীসটির বক্তব্য আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। যদি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তবে আমরা তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই কুরআন ও সুন্নাহ-এর নির্দেশ অনুসারে আমরা সনদ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই এবং নিম্নের বিষয়গুলি জানতে পারি:
(ক) বিশ্বে বিদ্যমান কোনো হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আমরা বলেছি, একটি হাদীস সাধারণত অনেকগুলি হাদীসের গ্রন্থে সনদ-সহ সংকলিত থাকে। কিন্তু এ হাদীসটি কোনো হাদীস গ্রন্থেই সংকলিত হয় নি।

(খ) আমরা দেখেছি যে, ইতিহাস, সীরাত, আকীদা, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও বহুসংখ্যক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদবিহীন বা সনদ-সহ সংকলিত। ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে এ সকল বিষয়ক কোনো একটি গ্রন্থেও এ হাদীসটির কোনো উল্লেখ নেই।

(গ)..............
সবগুলো পয়েন্ট তুলে ধরতে গেলে লেখা বিশাল হয়ে যাবে, তাই ওদিকে না গিয়ে.......... 

ইনিয়েবিনিয়ে আরও অনেক ব্যাখ্যা আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর দাঁড় করেছে উক্ত হাদিসটি জাল সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে; অথচ তাবে-তাবেঈন যুগের ইমাম— ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (রঃ) এবং হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-সহ আরও ৩৬ জন জগৎবিখ্যাত মনীষী তাঁদের কিতাবে সহীহ্ সনদে উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। একজন আলেম কি করে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করতে পারে? কাকে বিশ্বাস করবো/করবেন??  

সত্যতা যাচাই:

অনেক উদাহরণ দেয়ার দরকার নেই, সর্ব প্রথম আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা যে তাঁর প্রিয় হাবীব হুজুরপাক (সাঃ)-এর নূর সৃষ্টি করেন তার প্রমাণে নিন্মের হাদিসটিই যথেষ্ট—

عن جابر رصي الله عنه قال قلت يا رسول صلي الله عليه و سلم بابي انت و امي اخبرني عن اول شييء خلق الله تعالي قبل الاشياء قال يا جابر ان الله تعالي قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره فجعل ذالك النور يدور بالقدرة حيث شاء الله تعالي ولم يكن في ذالك الوقت لوح ولا قلم ولا جتة ولا نار ولا ملك ولا سماء ولا ارض ولا شمس ولا قمر ولا جني ولا انسي ….الي اخر
অর্থাৎ— হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্নিত; তিনি বলেন, আমি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবানি হউক, আপনি আমাকে জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম কোন জিনিস সৃষ্টি করেছেন?
তিনি বলেন, হে জাবের! নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম সব কিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেই নূর আল্লাহ পাকের ইচ্ছা অনুযায়ী কুদরতের মাঝে ঘুরছিলো; আর সে সময় লওহে মাহফুজ, কলম, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ ও জ্বিন কিছুই ছিলো না।

উল্লেখিত হাদিসটি নিন্মলিখিত কিতাবসমূহে নকল করা হয়েছে—

১. মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক; ১/৯৯, হাদীস নং ১৮
২. দালায়েলুন নবুওয়াত ১৩/৬৩
৩. মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া ১/৯
৪. মাদারেজুন নবুওয়াত ২/২
৫. যুরকানী ১/৪৬
৬. রুহুল মায়ানী ১৭/১০৫
৭. সিরাতে হালবীয়া ১/৩০
৮. মাতালেউল মাসাররাত ২৬৫ পৃ:
৯. ফতোয়ায়ে হাদীসিয়া ১৮৯ পৃ:
১০. নি’মাতুল কুবরা ২য় পৃ:
১১. হাদ্বীকায়ে নদীয়া ২/৩৭৫
১২. দাইলামী শরীফ ২/১৯১
১৩. মকতুবাত শরীফ, ৩য় খন্ড, ১০০ নং মকতুব
১৪. মওজুয়াতুল কবীর ৮৩ পৃ:
১৫. ইনছানুল উয়ুন ১/২৯
১৬. নূরে মুহম্মদী ৪৭ পৃ:
১৭. আল আনোয়ার ফি মাওলিদিন নবী ৫ পৃ:
১৮. নশরুতত্বীব ৫ পৃ:
১৯. তারীখুল খমীস ১/২০
২০. নুজহাতুল মাজালিস ১ম খন্ড
২১. দুররুল মুনাজ্জাম ৩২ পৃ:
২২. কাশফুল খফা ১/৩১১
২৩. তারিখ আননূর ১/৮
২৪. আনোয়ারে মুহম্মদীয়া ১/৭৮
২৫. আল মাওয়ারিদে রাবী ফী মাওলীদিন নবী ৪০ পৃষ্ঠা 
২৬. মজমুয়ায়ে ফতোয়া ২/২৬০
২৭. দেওবন্দী আজিজুল হক অনুবাদ কৃত বুখারী শরীফ ৫/৩
২৮. আপকা মাসায়েল আওর উনকা হাল ৩/৮৩
২৯. শিহাবুছ ছাকিব ৫০
৩০. মুনছিবে ইছমত ১৬ পৃ :
৩১. রেসালায়ে নূর ২ পৃ:
৩২. হাদীয়াতুল মাহদী ৫৬পৃ :
৩৩. মা’ য়ারিফে মুহম্মদী
৩৪. আনফাসে রহীমিয়া
৩৫. আফদ্বালুল ক্বোরা
৩৬. তাওয়ারীখে মুহম্মদ

হাদিসের সনদ—
১. হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
২. হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
৩. মুহাম্মাদ বিন মুনকাদার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
৪. মা’মার বিন রাশীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৫. আব্দুর রাজ্জাক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

বর্ণিত হাদিসের রাবীদের সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণের মন্তব্য—

ক) হাফেজে হাদিস, তাবে-তাবেঈন ইমাম আব্দুর রাজ্জাক রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে:
আহমাদ ইবন সালীহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, 'আমি একবার আহমাদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি হাদিস শাস্ত্রে আব্দুর রাজ্জাক রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে নির্ভরযোগ্য আর কাউকে পেয়েছেন কি? আহমাদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন— না'। —(তাহজিবুত তাহজিব লি হাফিয ইবনে হাজর আসক্বলানী; ২/৩৩১)

খ) অপর রাবী মা’মার বিন রাশীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে:
ওনার সম্পর্কে আহমাদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, 'আমি বাসরার সকল হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞের থেকে মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাকে মা’মার বিন রাশীদ এর সূত্রে পাওয়া হাদীসগুলো পছন্দ করি'।
ইবনে হাজর আসকলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহিও ওনাকে প্রখর স্মরণশক্তি সম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য বলেন। —(তাহজিবুত তাহজিব; ১/৫০৫, আসমাউর রেজাল।)

উক্ত মা’মার বিন রাশীদ রহমতুল্লাহি আলাইহি সূত্রে বর্ণিত বুখারী শরীফের হাদীস সংখ্যা প্রায় ২২৫ এবং মুসলিম শারীফে বর্ণিত হাদীস সংখ্যা প্রায় ৩০০।

গ) হাদিসটির আরেক রাবী মুহাম্মাদ বিন মুকদার রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে:
ইমাম হুমায়দি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মুকদার রহমতুল্লাহি আলাইহি একজন হাফিজ, ইমাম জারাহ তাদীলের ইমাম ইবন মা’ঈন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উনি নির্ভরযোগ্য।—(তাহজিবুত তাহজিব; ০৯/১১০৪৮,
আসমাউর রেজাল।)

হযরত মুকদার রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা বুখারী শারীফে ৩০টি এবং মুসলিম শারীফে ২২টি।

ঘ) আর মূল বর্ণনাকারী হলেন হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, যিনি একজন সুপ্রসিদ্ধ সাহাবী (রাঃ)। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ওনার থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস আছে। 

দেখা যাচ্ছে যে, হাদিসটির সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য এবং ওনাদের সূত্রে বোখারী ও মুসলিম শরীফেও অসংখ্য হাদীস বর্ণিত আছে; সুতরাং এ কথাটি বলার এখন আর কোন অপেক্ষা রাখে না, দ্বিধাহীন ভাবেই বলা যায়— ইমাম বুখারী ও মুসলিম-এর সংজ্ঞা ও শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ্। পরিশেষে একটি প্রশ্ন— আমরা কি পূর্ববর্তী জামানার বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দেসদের বিশ্বাস করবো, না কি শেষ জামানার দুনিয়াবি সুযোগ-সুবিধা নেয়া ঘড়ি মেকার নাসিরুদ্দিন আলবানী আর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে বিশ্বাস করবো??

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২২ জুন, ২০২১.

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১

দুই পূর্ব দুই পশ্চিমের ব্যাখ্যা :


'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন' নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পবিত্র কুর'আনুল কারীমে এ ধরণের বেশ কিছু আয়াতের মুখামুখি হয়েছি; যেমন— '……রাব্বিল মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি……' —(সুরা মুজাম্মেল : ৯), 'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন।' (সুরা আর রহমান : ১৭), ' ……বিরাব্বিল মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি……' —(সুরা মা’আরিজ : ৪০)........। এমন সবগুলো আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লেখা বিশাল হয়ে যাবে। তাই আজ শুধুমাত্র 'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন' নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করবো। 

'জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয।'—(ইবনে মাজাহ : ১ম খণ্ড - ২২৪) আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিস— 'দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর।' পবিত্র কুর'আনুল কারীমে 'তারা কি চিন্তা করে না', 'তারা কি গবেষণা করে না', 'তোমরা কি বোঝ না', 'তারা কি লক্ষ্য করে নাَ', 'তারা কি (সৃষ্টি প্রক্রিয়া) অবলোকন করে না?' এমনতর অসংখ্য বাক্য ব্যবহার করে মহান রাব্বুল আলামীন মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি- বিবেচনা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এতেই প্রমাণ হয়— জ্ঞানার্জন ছাড়া কখনই মুসলমান হওয়া যাবে না; ঈমানদার মু'মিন হওয়ার পথ তো বহু দূরের।

তাছাড়া মহাগ্রন্থ কুর'আনুল কারীম বুঝতে হলে অবশ্যই কিছু বিশেষ জ্ঞানের দরকার; যা সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। অন্যথায় গোমড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থ দিয়ে কুর'আন বুঝা যাবে না, অবশ্যই হিকমা অবলম্বন করে আয়াতের অভ্যন্তরীণ তাৎপর্য বুঝতে হবে।  সূর্য, সূর্যের উদয়স্থল এবং সূর্যের অস্তাচল নিয়ে পবিত্র কুর'আনুল কারীমায় অসংখ্য আয়াত রয়েছে; এদের কোনটা একবচনে, কোনটা দ্বি-বচনে, আবার কোনটা বহু-বচনে ব্যবহৃত। এসব বুঝতে হলে অবশ্যই খেয়াল বা দৃষ্টি প্রখর করতে হবে এবং ব্যাকারণ জ্ঞানও রাখতে হবে। 

 'উদয়াচল' এবং 'অস্তাচল' বলতে আসলে বুঝানো হয়েছে— সূর্য/নক্ষত্রের উদিত হওয়ার এবং অস্ত যাওয়ার স্থান; সেই অর্থে সুরা আর-রহমানে ব্যবহৃত 'মাশরিকাঈন'  ও 'মাগরিবাঈন' শব্দদ্বয় পুরোপুরি অর্থব্যঞ্জক। কি করে? আরবি ব্যাকরণে 'মাশরিক' ও 'মাগরিব' ব্যবহৃত হয় এক বচনে, 'মাশরিকাঈন' ও 'মাগরিবাঈন' ব্যবহৃত হয় দ্বি-বচন/ দুই বচনে, আর 'মাশরিকি'ও 'মাগরিবি' ব্যবহৃত হয় বহু বচনের ক্ষেত্রে; সুতরাং, উক্ত আয়াত দ্বারা  আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা  বলেছেন, 'তিনিই দুই উদয়াচল আর দুই অস্তাচলের মালিক'। 

'দুই উদয়াচল আর দুই অস্তাচল' কি করে সম্ভব? তা হলে কুর'আন কি অবৈজ্ঞানিক? মোটেও না। স্বনামধন্য মুসলিম মনীষীদের তাফসীরের উদ্ধৃত তুলে ধরার আগে আমি আপনাদের বিবেকের কাছে অতি সাধারণ কিছু প্রশ্ন করছি। আপনার কি কখনো মনে হয়নি দুনিয়াতে প্রতিদিন প্রতি ক্ষণে  দুইটা উদয়াচল দুইটা অস্তাচল হয় হচ্ছে? যদি না মনে হয়ে থাকেন, সমস্যা নেই, এখন একটু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করুন, ঢাকায় যখন সকাল হয় ঠিক সেই ক্ষণেই পৃথিবীর অন্য আরেক প্রান্তে কি সন্ধ্যা হয় না? আমাদের সকাল হয় যে সময়ে মক্কায় কি সকাল সেই একই সময়ে হয়? এতেই তো বুঝা যায় দুই উদয়াচল আর দুই অস্তাচলের কনসেপ্ট সঠিক। আমার গবেষণা, উক্ত আয়াতের দ্বারা পৃথিবীর পর্যায়ক্রমিক দুই সকাল দুই সন্ধ্যার কথা বলা হয়েছে। এমন করে  মিলাতে চেষ্টা করলে দেখবেন পবিত্র কুর'আনুল কারীমের কোন আয়াতই বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যায় না।

পদার্থবিজ্ঞানে শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে যে, বিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ ধ্রুবক; শক্তি অবিনশ্বর, শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, করা যায় না। এক রূপ থেকে শক্তিকে কেবলমাত্র অন্য রূপে রূপান্তরিত করা যায়; যেমন— একটি ডিনামাইট-এর বিস্ফোরণের ফলে রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় | যারা সত্যিকারার্থে বিজ্ঞান বুঝে না, তাদের জন্য শক্তির নিত্যতার সূত্রটা ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করাটাই যথেষ্ট; এতেই বিজ্ঞানের অনেক কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। সারে চৌদ্দশ বছর আগে পবিত্র কুর'আনুল কারীম ঘোষণা দিয়েছে 'সূর্য পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র তার নিজ অক্ষে আবর্তনমান'। বিজ্ঞান বলে, কোন বস্তু আবর্তন করে যদি বস্তুটি গোলাকার হয় এবং সেই বস্তুর শক্তি নিত্য হয়। আমরা জানি, পৃথিবী সূর্য বা যে কোন গ্রহ নক্ষত্রের আকৃতি গোলাকার। তাই প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রই অনবরত নিজ অক্ষে আবর্তনমান। আর আবর্তনমান সকল বস্তুতে পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া বিদ্যমান। সূর্যের আলো ঠিক এই মূহুর্তে পৃথিবীর যে অংশে পড়ছে, একটু পরেই তা আর সেখানে থাকবে না, সরে যাবে; আমেরিকায় এখন রাত, আমাদের এখন দিন। তাই বলা যায়, প্রতি মূহুর্তেই পৃথিবীতে উদয়াচল ও অস্তাচল ঘটছে; যা যুগপৎ ঘটনা। এ কি দুই উদয়াচল দুই অস্তাচল নয়? 

বিজ্ঞান বলে সূর্য ৩৬০ দিন ৩৬০টি রেখায় চলে, আর তার এ চলার প্রতিটি রেখা স্বাতন্ত্র্য; ফলে প্রতিক্ষণেই সূর্যের উদয়াচল ও অস্তাচলের পরির্বতন ঘটছে। গোলাকার পৃথিবীর সব অংশে কখনো কি এক সাথে রাত দিন হচ্ছে, না হওয়া সম্ভব? আামাদের এখানে যখন সকাল, আমেরিকায় তখন রাত; একই সময়ে দু স্থানে দুই রকম অবস্থা বিরাজমান; এটি একটি যুগপৎ ঘটনা, যা দিনে দুই দুই বার ঘটছে। পৃথিবীর এক স্থানে যখন সকাল, ঠিক সেইক্ষণেই পাশের আরেক অংশে ভোর হতে অনেক দেরি। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়— দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলে আয়াত শতভাগ সত্য ও বৈজ্ঞানিক। যারা ভাবেন অনেক বিষয়ে বিজ্ঞানের সাথে কোর'আনের বর্ণনা মেলে না বা যায় না; তাদের বলছি— আপনি আমার একটি স্পষ্ট কথা আজ শুনে যান— বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছে কোর'আন, আর বিজ্ঞানী সৃষ্টি করেছে যে তাঁর বাণী হলো কোর'আন। বিজ্ঞান আলাদা কোন কিছু নয়, কোর'আনের অতি ক্ষুদ্র একটি নির্যাস।

বিজ্ঞান কি? ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ইংরেজি শব্দ Science মূলত ল্যাটিন Scientia থেকে এসেছে, যার মানে Knowledge, অর্থাৎ জ্ঞান। বিজ্ঞান-এর অর্থ বিশেষ জ্ঞান। ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষ জ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানবিদ কিংবা বৈজ্ঞানিক নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জ্ঞান অর্জন করেন এবং প্রকৃতি ও সমাজের নানা মৌলিক বিধি ও সাধারণ সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। বর্তমান বিশ্ব এবং এর প্রগতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানের মাধ্যমে; তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাপক অর্থে যে কোনো জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণকে বিজ্ঞান বলা হয়।

জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ না জেনে আজকাল তথাকথিত কিছু আলেম কোর'আন-হাদিসের সাথে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করতে গিয়ে এমন সব আবোলতাবোল কথা বলছেন যার কোন মাথামুণ্ডু নেই। আর এর খেসারত শুনতে হচ্ছে আমাদের; পুরো মুসলমান জাতিকে তারা হাসির পাত্র বানাচ্ছে! বিজ্ঞানের সাথে কম্পেয়ার বা তুলনা করে যারা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের আয়াত বা হাদিসের ব্যাখ্যা করেন, তাদের অবশ্যই জানা ও বুঝা উচিত— বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই আগে আপনাকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে; নয়তো কাজী ইব্রাহীমের মতো হাসির পাত্র হতে হবে। অবশ্য ইদানীং লক্ষ্য করছি আমাদের দেশের বেশকিছু তরুণ আলেমে-দ্বীন বেশ গুছিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়াজ-নসীহত করছেন; এটা শুভ লক্ষ্মণ, খুবই ভালো। 

বিজ্ঞান না জানা এবং গবেষণাবিহীন অনভিজ্ঞ আলেমদের বিজ্ঞানভিত্তিক মিথ্যা ওয়াজ শুনে আজকাল অনেক মুসলমানের মনেই প্রশ্ন জাগে— কোর'আন-হাদিস সত্য, নাকি বিজ্ঞান সত্য? পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদিসের একজন সাধারণ অনুসারী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক-গবেষক হিসেবে আমি আবিষ্কার করেছি— বিজ্ঞানের প্রতিটি সীদ্ধান্ত ক্ষণস্থায়ী, অস্থির, সাময়িক ও পরিবর্তনশীল; আর পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদিসের প্রতিটি বর্ণ-শব্দ-বাক্য চিরস্থায়ী, শ্বাশত, স্থির ও চিরসত্য। অতএব বিজ্ঞান দিয়ে একজন মুসলমানকে কোর'আন হাদিস  বুঝতে হবে না বুঝাতে হবে না, কোর'আন হাদিস দিয়ে বিজ্ঞান বুঝতে হবে বুঝাতে হবে। আপনারা যদি তা করতে পারেন, আমি নিশ্চিত— আবারও পৃথিবী মুসলমানদের পদানত হবে।

সূর্য ঘুরে না পৃথিবী ঘুরে? এ বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক মতানৈক ছিল; যেমন— একসময় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মহাবিশ্বের সব কিছুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, অর্থাৎ পৃথিবী স্থির। এ ধারণাটি পরবর্তী বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ভুল বলে প্রমাণিত হয়। পোল্যান্ডের জ্যোতিবিজ্ঞানী কোপানিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) প্রথম বলেন— পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে; কিন্তু তখনকার মানুষ  তার এ কথাটি বিশ্বাস করেনি। পরবর্তীযুগে বিজ্ঞানী নিউটন এসে যখন আবিস্কার করলেন— পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে এবং পক্ষান্তরে সূর্যও তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে; সূর্য কেন্দ্রিক এই মডেলটিই বর্তমানে প্রমানিত এবং বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ এ কথাটি গ্রহনও করে নিয়েছে। এ থিওরীও  হয়তো একদিন পালটে যাবে, যেমন করে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তাই বলি কি— ক্ষণস্থায়ী বিজ্ঞান নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই; অস্থায়ী পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শুধু জানতে ও বুঝতে হবে।

সাড়ে ১৪শত বছর আগে কোর'আন যা বলেছে বিজ্ঞান আজ তার কিয়দংশ মাত্র প্রমাণ করেছে; চন্দ্র, সূর্য ওপৃথিবীসহ মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহই নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তনমান; সুরা আম্বিয়ার ৩৩ নং আয়াত— 'এবং তিনিই দিবা-নিশি এবং চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করেছেন। সবাই আপন আপন কক্ষ পথে বিচরণ করে।'  এ আয়াত বুঝাতে গিয়ে সেই সময় হুজুর পাক (সাঃ)-এর চাচাতো ভাই ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছিলেন, 'লাটিম যেমন তার কেন্দ্র বিন্দুর চার দিকে ঘুরতে থাকে, সূর্যও তেমনিভাবে ঘুরে।' এখন বুঝুন জ্ঞানী মুসলমানরা কতটা বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন।  

সুরা ইয়াসীনের ৩৮-৪০ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বলেন, 'সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা, পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নির্ধারণ। চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্যের পক্ষে চন্দ্রকে নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। রাতের পক্ষেও দিনের অগ্রবতী হওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।' সুরা যুমারের  ৫ নং আয়াতে রাব্বুল ইজ্জত বলেন, 'তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিযুক্ত করেছেন। প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত জেনে রাখুন, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।' এসব আয়াতে যে পৃথিবী ঘুর্নায়মানের ইঙ্গিত রয়েছে তা নিশ্চিত। সুতরাং পৃথিবীর ঘুর্নায়মান হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন' নিয়ে 'আল-কুরআনুল করীম', ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ— 'তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা।' প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান সাহেবের অনুবাদও প্রায় একই রকম— 'তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই আস্তাচলের নিয়ন্ত্রণকারী।' ইসরাইলী চক্রান্তের ফসল গুগল প্লে-স্টোরের মোবাইল অ্যাপের অনুবাদগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন; সেসবে দেখতে পাবেন কত ভিন্ন ওদের অনুবাদ। আমি যেটা পেলাম সেখানে  অনুবাদ করা আছে— 'তিনি দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিমের রব।'  বর্তমান যুগের শর্টকাটে জান্নাত পাওয়ার প্রত্যাশা করা মুসলমানরাই এসব অনুবাদ ডাউনলোড করে। তারা হার্ডকপি কিনতে চায় না; গুগল প্লে-স্টোরের এইসব  মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করেই কোর'আন বুঝতে চায় জানতে চায়, বিজ্ঞ সাজতে চায়। আর এতেই ঘটছে যত বিপত্তি। তথাকথিত ইমামসাব মুফতিসাব মাওলানা সাবরা বুঝতেও পারে না এসব বিভ্রান্ত অর্থ বয়ান করে মুসলিম সমাজকে তারা কতটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সমাজের সবখানে আজ এসব নিয়ে তর্কাতর্কি বিতর্ক চলছে, দুই লাইন পড়েই আবার কেউ কেউ চেহারা আর কণ্ঠকে পুঁজি করে মুফতীসাব/পীরসাব সাজছে, এবং দেদারছে লোক ঠকাচ্ছে। 

ইসরাইলী চক্রান্তের এ'সব ভ্রান্ত অর্থ পড়ে পড়ে নিজেরা তো গোমড়া হচ্ছেই, বলদরা বলদার মতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আবার অন্যকেও ও'সব শোনাচ্ছে এবং পথভ্রষ্ট করছে। তাই, উপদেশ দেবো বাংলা অনুবাদের ইসলামিক কিতাব কিনতে বা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের বাংলা অনুবাদ পড়তে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। উপদেশ দেবো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ কেনা ও পড়ার জন্য; অথবা যাচাই-বাছাই করে সঠিক অনুবাদ কিনুন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা বাংলা একাডেমির অনুবাদকে আমি  প্রেফারেন্স করি, কারণ ওখানে অনুবাদকদের একটা বোর্ড থাকে।

যাই হউক, উক্ত আয়াতের তাফসিরে তাফসীরে মাযহারীতে কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (র) লিখেছেন, এখানে 'দুই উদয়স্থল' ও 'দুই অস্তস্থল' অর্থ গ্রীষ্ম ও শীতকালে সূর্যের পৃথক পৃথক উদয়স্থল ও অন্তস্থল। তাফসীরে তাবারী ও ইবনে কাসির-এ প্রায় একই ধরনের বিষয়  উল্লেখ্য— গ্রীষ্ম ও শীতকালে সূর্যের উদয়াচল এবং অস্তাচল পরিবর্তিত হয়। আলোচ্য আয়াতে 'মাশরিকাঈনি বলে এই শীত ও গ্রীষ্মের দুই উদয়াচল এবং মাগরিবাঈন বলে শীত ও গ্রীষ্মের দুই অস্তাচলকে বুঝানো হয়েছে। এখানে দ্বিবচন দ্বারা বহুবচন উদ্দেশ্য; যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি শপথ করছি উদয়াচল সমূহের ও অস্তাচল সমূহের প্রতিপালকের (মা'আরজি ৭০/৪০)। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অন্যত্র বলেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা এবং পালনকর্তা উদয়াচল সমূহের (সাফফাত ৩৭/৫)। এসব আয়াতসমূহে আসলে সৌর বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস বর্ণিত হয়েছে। 

২০১১ সালে নাসা মহাকাশে এমন একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছে যা দুটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে; সেখানে একই দিনে দুই সূর্যোদয় এবং দুই সূর্যাস্ত একটি গতানুগতিক বিষয়। নাসা জানিয়েছে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র কেপলারের সহায়তায় পৃথিবী থেকে ২০০ আলোকবর্ষ দূরে কেপলার-১৬বি নামের এরূপ একটি গ্রহ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে; খোদ বিজ্ঞানী মহলের কাছে এটি একটি চমকপ্রদ বিষয়। শনি গ্রহের মতোই বিশাল শীতল এই গ্যাসীয় গ্রহটির দুটি সূর্য আমাদের সূর্যের চেয়ে ৬৯ ও ২০ শতাংশ ছোট ও তুলনামূলকভাবে শীতল। তাই কেপলার- ১৬বি এর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা -৭৩ এবং -১০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ২২৯ দিনে একবার দুই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এখন একবার চিন্তা করে দেখুন আল্লাহর পুরো রাজত্ব 'সামাওয়াতি ওয়াল আর্দ' কতটা বিশাল। এই বিশাল সাম্রাজ্যের কতটা খবর আপনি রাখেন? 

কুর'আনুল কারীমের সঠিক বুঝ না থাকায় আজকের মুসলিম সমাজের অনেকেই বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়! অথচ বিজ্ঞান হলো নাম্বার 7 (সাত)-এর অসংখ্য  নির্যাসের মাত্র একটি। আল্লাহর বিশাল রাজত্বে সৌরজগত পরের কথা, সংখ্যা তত্ত্বের ছোট্ট একটি মৌলিক সদস্য 7 (সাত)-এর রহস্যই এখনো পর্যন্ত মানুষ বেধ করতে পারেনি, মহাকাশের দ্বার উন্মোচন— সে তো বহু দূর! 

তবে, এরই মাঝে ১১৮টি  মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা; যার মধ্যে ৯৮টি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, বাকী ২০টি কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা হয়েছে।  বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে;  হয়তো নতুন আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করবে; ধাপে ধাপে মানুষ হয়তো রহস্যের অনেক দ্বারই উন্মোচন করবে। কিন্তু তা-ই-বা কতটুকু? নিশ্চয়  স্রষ্টার রাজত্বের এক কানাকড়িও নয়।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
১৪ জুন, ২০২১.