কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
এই কি ভালে ছিল রে লিখা--
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।
আলো নিয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসা চিরকালের; কত কি চিন্তা, কত কি সে কবিতা— যার কোন অন্ত ছিল না এবং নেই। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আলো হলো এক ধরনের শক্তি বা বাহ্যিক কারণ, যা চোখে প্রবেশ করে দর্শনের অনুভূতি জাগায়; বস্তুকে দৃশ্যমান করে, কিন্তু নিজে অদৃশ্য। আলোকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু যে কোন আলোকিত বস্তুকে সহজেই দেখতে পাই; যদি চোখে জ্যোতি থাকে। প্রকৃতপক্ষে আলো হলো এক ধরনের বিকীর্ণ শক্তি, যা তরঙ্গ হিসেবে প্রস্ফুটিত; তির্যক তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আকারে আলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে পারে, মাধ্যমভেদে যার বেগের পরিবর্তন হয়। বৈজ্ঞানিক সত্য— মাধ্যম ভেদে আলোর বেগ মাধ্যমের ঘনত্বের ব্যস্তানুপাতিক। শুন্য মাধ্যমে আলোর বেগ সবচেয়ে বেশি, কিন্তু অসীম নয়; শূন্যস্থানে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ২৯,৯৭,৯২,৪৫৪ মিটার বা ১,৮৬,০০০ মাইল। আলোর গতিকে কোন ভাবেই স্পর্শ করা যায় না, সম্ভব নয়। তাছাড়া আলোর কোনো আপেক্ষিক বেগ নেই; এ বেগ সর্বদাই সমান।
আলো আসলে কি? আমরা যা দেখি সেই দৃশ্যমান আলো মূলতঃ তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালির ছোট একটি অংশ মাত্র। সাদা আলো সাতটি রঙের মিশ্রণ, প্রিজম এর দ্বারা আলোকে বিভিন্ন রঙে (৭ রঙ) আলাদা করা যায়; যা আমরা রামধনু হিসেবেি দেখতে পাই। আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরন, আপবর্তন, ব্যাতিচার ইত্যাদি হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো আলোর একই সাথে কণা ধর্ম ও তরঙ্গ ধর্ম বিদ্যমান। দীপ্তমান বস্তু থেকে আলো কীভাবে আমাদের চোখে আসে তা ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত চারটি তত্ত্ব প্রদান করেছেন—
১). স্যার আইজ্যাক নিউটনের Corpuscular Theory বা কণা তত্ত্ব;
২). বিজ্ঞানী হাইগেনের Wave Theory বা তরঙ্গ তত্ত্ব;
৩). ম্যাক্সওয়েলের Electromagnetic Theory বা তড়িতচৌম্বক তত্ত্ব;
এবং
৪). ম্যাক্স প্লাঙ্কের Quantum Theory বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আলোর ঘটনার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করান, যার স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯২১ সালে তিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারও পান।
পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের আলোর এবং সকল শক্তির মূল উৎস হলো সূর্য; সৌর ধ্রুবক নামে একটি পদের ব্যবহারই এই উৎসের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে। সূর্যের দিকে সরাসরি মুখ করে থাকা পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর সূর্য প্রদত্ত শক্তির পরিমাণকে সৌর ধ্রুবক বলে; এর আপাত মান হচ্ছে ১,৩৭০ ওয়াট/বর্গমিটার। এই মানটি সূর্য থেকে এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক দূরত্বে অবস্থানকারী যে কোন বস্তুর পৃষ্ঠের জন্য প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকেই এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দূরত্ব বলা হয়। পৃথিবীতে এতোটা শক্তি পৌঁছালেও তার পুরোটা পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছে না। যখন আবহাওয়া সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে এবং সূর্য সর্বোচ্চ বিন্দুতে থাকে তখন ভূ-পৃষ্ঠে সরাসরি পতিত সৌর শক্তির পরিমাণ হয় প্রায় ১,০০০ ওয়াট/বর্গমিটার। এই শক্তিকে কাজে লাগানোর অনেকগুলো প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায় আছে। উদ্ভিদ এই শক্তি ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে, যা থেকে প্রাপ্ত শক্তি তারা রাসায়নিক শক্তি অক্সিজেন ও স্বল্প পরিমাণ কার্বন যৌগে পরিণত করে। আবার কৃত্রিমভাবে সৌর শক্তির মাধ্যমে সরাসরি উত্তপ্ত করে বা সৌর কোষ জাতীয় বৈদ্যুতিক পরিবর্তকের মাধ্যমে সৌর শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে, যা আমাদের অনেক কাজে লাগে। পেট্রোলিয়ামসহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানীতে যে শক্তি নিহিত থাকে তা-ও উদ্ভিদ সৌর শক্তি থেকে লাভ করে। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত শক্তিই নানাভাবে পরিবর্তীত হয়ে এ ধরনের জ্বালানীর দাহিকাশক্তির যোগান দেয়। তাছাড়া সূর্যের আলোর বেশ কিছু চমৎকার জীববৈজ্ঞানিক ধর্ম রয়েছে।
সৌর আলোর লুমেন ও ওয়াটের মধ্যে যে অনুপাত তা ভাল মানের প্রতিপ্রভ আলোর সাথে তুলনীয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় সূর্য যে আলো দেয় তা তার উত্তপ্ত করার ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং প্রদত্ত এই আলোর পরিমাণ বিপুল। এ থেকেই গ্রীষ্মকালে গৃহাভ্যন্তরের আলোকসজ্জার জন্য সূর্যের আলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। কারণ এটি যত না উত্তপ্ত করে তার চেয়ে বেশি আলোকিত করে, আর গ্রীষ্মকালে উত্তাপ কমানো প্রয়োজন। অবশ্য সূর্যের আলোও কিছু উত্তাপ ছড়ায়। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতি একদিকে বেশি উত্তাপ তো ছড়ায়ই, আবার বিদ্যুৎও ব্যবহার করে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির কিছু প্রতিষেধক গুণ রয়েছে যা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণে কাজে লাগে। সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি তৈরি করে যা মানব শরীরের জন্য উপকারী।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আলোর প্রধান উৎস এই রবি বা সূর্য হলো আমাদের এই সৌরজগতের প্রধান নক্ষত্র; সকল শক্তির উৎস। লক্ষ তারার মাঝে প্রায় আদর্শ গোলক আকৃতির সূর্য নামের এই তারাটি প্রধানত প্লাজমা তথা আয়নিত পদার্থ দিয়ে গঠিত, যার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে চৌম্বক ক্ষেত্র। এর ব্যাস প্রায় ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার; যা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ বেশি। আর ভর প্রায় ২×১০৩০ কিলোগ্রাম, তথা পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ ৩০ হাজার গুণ বেশি; এই ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ। সূর্যের প্রধান গাঠনিক উপাদান হলো হাইড্রোজেন; মোট ভরের তিন চতুর্থাংশই হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেনের পরেই সবচেয়ে প্রাচুর্য্যময় মৌলটি হলো হিলিয়াম। হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল সূর্যের মাত্র ১.৬৯% ভরের জন্য দায়ী; তারপরও এদের সম্মিলিত ভর পৃথিবীর ভরের ৫,৬২৮ গুণ। এই ভারী মৌলগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, লোহা ইত্যাদি।
সূর্যও একটি তারা; তারার শ্রেণীবিন্যাস করার একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে, সেই অনুসারে সূর্য জিটুভি (G2V) শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। অনেক সময় একে হলদে বামন বলেও ডাকা হয়; কারণ তার তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি বর্ণালীর হলুদ-সবুজ অংশে। সূর্যের রঙ সাদা হলেও ভূপৃষ্ঠ থেকে একে হলুদ দেখাতে পারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নীল আলোর বিচ্ছুরণের কারণে। বর্ণালী ধরন 'জিটু' বলে দেয় সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা আনুমানিক ৫৭৭৮ কেলভিন বা ৫৫০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর 'ভি' দিয়ে বুঝায় আকাশগঙ্গার অধিকাংশ তারার মত সূর্যও একটি প্রধান ধারার তারা; অর্থাৎ যার কেন্দ্রভাগে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরাম হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে যাচ্ছে। কেন্দ্রে সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পোড়ায়।
আগের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যকে অনুজ্জ্বল ও বেশ তাৎপর্যহীন একটি তারা মনে করতেন, কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান থেকে জানা যাচ্ছে আকাশগঙ্গার শতকরা ৮৫ ভাগ তারার চেয়ে সূর্যের উজ্জ্বলতা বেশি; প্রকৃতপক্ষে আকাশগঙ্গার অধিকাংশ তারাই লোহিত বামন। সূর্যের পরম মান +৪.৮৩; কিন্তু পৃথিবীর খুব কাছে হওয়ার কারণে আকাশে একে অন্য যেকোন বস্তুর চেয়ে অনেক উজ্জ্বল দেখায়, তাই আপাত মান অনেক কম; -২৬.৭৪। সূর্যের করোনা অবিরত মহাশূন্যে প্রসারিত হতে থাকে যে কারণে সৌরঝড়ের জন্ম হয়। সৌরঝড় মূলত আয়নিত কণার ধারা, যা হেলিওপজ তথা প্রায় ১০০ নভো-একক (সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের ১০০ গুণ) পর্যন্ত ধেয়ে যায়। সৌরঝড়ের মাধ্যমে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে সৃষ্ট হেলিওস্ফিয়ার বা সৌরমণ্ডল সৌরজগতের বৃহত্তম অবিচ্ছিন্ন কাঠামো।
সূর্য বর্তমানে স্থানীয় বুদবুদ অঞ্চলের স্থানীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছে যা আকাশগঙ্গার কালপুরুষ বাহুর ভেতরের দিকে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে ১৭ আলোকবর্ষ দূরত্বের মাঝে, তথা সবচেয়ে নিকটবর্তী ৫০টি তারার (সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেন্টরি ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে) মধ্যে সূর্য ভরের দিক দিয়ে চতুর্থ। সূর্য আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আনুমানিক ২৪ - ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং কেন্দ্রের চারদিকে ২২.৫ থেকে ২৫ কোটি বছরে একবার ঘুরে আসে। ছায়াপথীয় উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের এই আবর্তন ঘড়ির কাঁটার দিকে।
আমাদের ছায়াপথ যেহেতু মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের (পটবিকিরণ) সাপেক্ষে হ্রদসর্প মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে ৫৫০ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হচ্ছে সেহেতু পটবিকিরণের সাপেক্ষে সূর্যের বেগ কাংস্য বা সিংহ মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব আনুমানিক ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার যাকে ১ নভো-একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে পৃথিবীর কক্ষপথ যেহেতু উপবৃত্তাকার সেহেতু সূর্য থেকে তার দূরত্ব পরিবর্তিত হয়, জানুয়ারি মাসে সে সূর্যের সবচেয়ে কাছে (অনুসূর) আসে এবং জুলাইয়ে সবচেয়ে দূরে (অপসূর) সরে যায়। যাহোক, গড় দূরত্বে সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় নেয়। এই সূর্যালোকের শক্তি পৃথিবীর প্রায় সকল জীবকে বাঁচিয়ে রাখে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এই আলো থেকে খাদ্য উৎপাদন করে, এবং প্রাণীরা খাদ্যের জন্য এসব উদ্ভিদ বা অন্য প্রাণীর উপর নির্ভর করে। পাশাপাশি জলবায়ু এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও সূর্যালোক প্রধান ভূমিকা রাখে।
পৃথিবীর উপর সূর্যের বিশাল প্রভাব সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ অনুধাবন করে আসছে। অনেক সংস্কৃতিতেই সূর্যকে দেবতা মনে করা হতো এবং এখনো হয়। প্রকৃতপক্ষে সূর্য তার কেন্দ্রভাগে সংঘটিত নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরাম হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে তাপ-উত্তাপ সৃষ্টি করে সৌরজগতে বিকিরণ ঘটাচ্ছে, যার কিয়দংশ পৃথিবীতে আপতিত হচ্ছে। তবে সূর্যের প্রকৃত কাঠামো সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাও সূর্যের গাঠনিক উপাদান এবং শক্তির উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতেন না। এখনও সূর্য নিয়ে গবেষণা চলছে কারণ তার কিছু ব্যবহার এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি, যায় না।
সূর্যের আলোয় কত কি উপকার, কত কি হিসাব-নিকাশ, কত কি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা; কিন্তু সূর্য এলো কোত্থেকে, আলোই-বা পায় কোয়ায়? বিজ্ঞান কি এর কোন সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড় করতে পেরেছে, না-কি পারবে? হাজার জীবনেও কি এর সমাধান সম্ভব??
পবিত্র কুরআনুল কারিমে উল্লেখ্য— 'আল্লা-হু নূরুস্ সামা-ওয়া-তি অল্-আদ্ব্; মাছালু নূরিহী কামিশ্কা-তিন্ ফীহা-মিছ্বাহ্; আল্ মিছ্বা-হু ফী যুজ্বা-জ্বাহ্; আয্যুজ্বা-জ্বাতু কাআন্নাহা-কাওকাবুন্ র্দুরিইয়ুঁই ইয়ূক্বদু মিন্ শাজারতিম্ মুবা-রকাতিন্ ইতূনাতিল্লা-র্শাক্বিয়্যাতিঁও অলা-র্গবিয়াতিঁ ইয়াকা-দু যাইতুহা-ইয়ুদ্বী-য়ু অলাও লাম্ তাম্সাস্হু নার্-; নূরুন্ ‘আলা র্নূ; ইয়াহ্দিল্লা-হু লিনূরিহী মাই ইঁয়াশা-য়্; অইয়াদ্ব্রিবুল্লা-হুল্ আম্ছা-লা লিন্না-স্; অল্লা-হু বিকুল্লি শাইয়িন্ ‘আলীম্।' যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়— আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর। তাঁর নূরের উপমা একটি তাকের মতই। তাতে রয়েছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি রয়েছে একটি চিমনির মধ্যে। চিমনিটি উজ্জ্বল তারকার মতই। প্রদীপটি বরকতময় যাইতূন গাছের তেল দ্বারা জ্বালানো হয়, যা পূর্ব দিকেরও নয় এবং পশ্চিম দিকেরও নয়। এর তেল যেন আলো বিকিরণ করে, যদিও তাতে আগুন স্পর্শ না করে। নূরের উপর নূর। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন তাঁর নূরের দিকে। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উপমাসমূহ উপস্থাপন করেন। আর আল্লাহ প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।'
নূর শব্দের বাংলা অর্থ হলো আলো বা জ্যোতি; প্রকৃত অর্থে এ শব্দটি দ্বারা 'দৃশ্যমান' আলো বুঝায়, রূপক অর্থে 'অদৃশ্যমান আলো' তথা হেদায়েত, জ্ঞান ইত্যাদি বুঝায়। জগৎ বিখ্যাত মনীষী হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেছেন—আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাই হলেন আলোর একমাত্র উৎস; আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর বেলায় আলো শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়, বাস্তব অর্থে নয়। জ্ঞানের তারতম্যানুসারে আলো শব্দটি এক এক জনের কাছে একেক রকম হয়; যেমন— ১). সাধারণের কাছে, ২). বিশেষ লোকদের কাছে, এবং ৩). বিশিষ্ট লোকদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়; যার আবার ভিন্ন ভিন্ন স্তরও রয়েছে। মূল কথা হলো আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাই হলেন চরম আলো এবং পরম নূর। তিনিই সত্যিকার ও প্রকৃত একক জ্যোতি এবং অন্য কেউ বা কোনকিছু তাঁর মতো নয়, এর সাথে অন্য কোন কিছুর শরীকও নেই।
সাধারণের দৃষ্টিতে আলো মানে 'প্রকাশ' বা 'পরিদৃশ্যমান জগত'। আর এই প্রকাশ হচ্ছে একটি সম্বন্ধযুক্ত ক্রিয়া; কেননা এখানে প্রতিটি জিনিস অপরটির কাছে প্রকাশিত হয়, আবার অপরটি হতে লুকায়িতও থাকে। অতএব, প্রকাশ এবং গোপন উভয়ই সম্বন্ধযুক্ত। সাধারণের কাছে পঞ্চইন্দ্রিওয়ের মধ্যে দৃষ্ট শক্তির সাথে সম্পৃক্ত কোন একটা অনুভূতিই আলো। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বস্তুকে তিনভাগে ভাগ করা যায়—
১). যা দৃষ্টিগোচর হয় না; কালো বস্তু।
২). যা দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্ত তা দিয়ে অন্য কোন বস্তু দেখা যায় না; উজ্জ্বল বস্তু, নক্ষত্র, অনুজ্জ্বল অগ্নি।
৩). যা দৃষ্টি গোচর হয় এবং তা দিয়ে অন্য বস্তুও দেখা যায়; চন্দ্র, সূর্য, স্ফুলিঙ্গ, অগ্নি, প্রদীপ ইত্যাদি; এই তৃতীয় প্রকারই আলো নামে অভিহিত। কখনো কখনো আবার উজ্জ্বল বস্তু হতে বস্তুর উপর প্রতিফলিত আলোকেও 'আলো' বলা হয়। সংক্ষেপে বললে বলতে হয়— যে বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় এবং তা দিয়ে অন্য বস্তুও দেখা যায় তাকেই আলো বলে।
আলোর বৈশিষ্ট্য হলো প্রকাশ ও দর্শন; আর এই প্রকাশ ও দর্শন নির্ভর করে দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের উপর। আলো প্রকাশ পেলে এবং অন্য বস্তুকে প্রকাশিত করলেও অন্ধ ব্যক্তির পক্ষে তাতে কোন উপকার হয় না। 'আলো' শব্দ দ্বারা প্রকৃত অর্থে আমরা আলো দেখার যন্ত্র চোখকেই বুঝি। এ কারণেই তত্ত্বানুসন্ধানীরা দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের আলোকেই 'আলো' বলে অভিহিত করেছেন। তাই চামচিকে সম্বন্ধে বলা হয় যে তার চোখের আলো ক্ষীণ, দূর্বল।
মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীব হুজুর পাক (সাঃ)-কে জগতের আলো বা নূর হিসেবে সৃষ্টি করে সীমাহীন উজ্জ্বল মুনাওয়ার হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং নাম দিয়েছেন নূর এবং সীরাজুম্মুনীরা। এই নামকরণের যৌক্তিকতা ও স্বার্থকতা তো অবশ্যই আছে এবং থাকবে, তাই নয় কি? যেহেতু জগৎবাসী তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের পথ পেয়েছে, এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জামাল ও কামালের মাধ্যমেই জগৎবাসী দৃষ্টিশক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সেটা কোন সাধারণ ব্যক্তি বা মানুষের দ্বারা কি সম্ভব ছিল?
এ মর্মে আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কুর'আনুল করীমে স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর) এসেছে এবং একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ।' —(সূরা মায়েদা : ১৫) উক্ত আয়াতের তাফসীরে তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে খাজেন, তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে বায়জাবীসহ অনেক শ্রেষ্ঠ তাফসীরকারক এখানে এ 'নূর'-কে আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কেই বুঝানো হয়েছে বলে মত দিয়েছেন এবং 'কিতাবুমমুবীন' দিয়ে কুর'আনুল কারীম-কে বুঝানো হয়েছে বলেছেন। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে মাযহারীতে কাজী মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ পানীপথী (রঃ) লিখেছেন, 'আলাহর নিকট থেকে তোমাদের নিকট এক জ্যোতি এসেছে' অর্থাৎ 'নূর' জ্যোতি দ্বারা উদ্দেশ্য মুহাম্মদ (সাঃ; 'এবং এক সুস্পষ্ট কিতাব' অর্থাৎ আহকাম ও বিধানকে সুস্পষ্টকারী কিংবা স্পষ্ট মু’জিযা বিশিষ্ট কিতাব, কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য 'কুরআন' বলেছেন।
আলোর সৃষ্টি ও এর উৎস-উৎপত্তির সারকথা জানতে হলে অবশ্যই সৃষ্টির গোড়ায় যেতে হবে, নয়তো এ রহস্য কোন মানুষের পক্ষে কোনভাবেই ভেদ করা সম্ভব হবে না। স্রষ্টার সৃষ্টির ইতিহাসের শুরুটা সারসংক্ষেপে কিয়দংশ হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র কিতাব 'দাকায়েকুল আকবার' থেকে নকল করছি। বইয়ের শুরুতেই 'হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর সৃষ্টি রহস্য' লিখতে গিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ হাদিস তুলে ধরেছেন—
আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম 'শাজ্বারাতুল ইয়াকীন' নামে চারি কাণ্ড বিশিষ্ট একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন। তারপর নূরে মুহাম্মদীকে ময়ুরের আকৃতিতে শুভ্র মুক্তার আবরণের মধ্যে সৃষ্টি করিয়া উক্ত বৃক্ষের উপর রাখিয়া দেন। সত্তুর হাজার বৎসর তিনি এইরূপ অবস্থায় আল্লাহ পাকের তাসবীহ পাঠে নিবিষ্ট থাকেন।
অতপর আল্লাহ পাক লজ্জার আয়না তৈরী করিয়া তাঁহার সন্মুখে রাখেন। তিনি যখন স্বীয় সুন্দর লাবণ্যময় ও জাঁকজমকপূর্ণ ছবি আয়নার মধ্যে দেখিতে পান, তখন লজ্জিত হইয়া আল্লাহ তাআ'লাকে অবনত মস্তকে পাঁচবার সেজদা করেন। এই কারণেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতের উপর দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হইয়াছে।
আল্লাহ পাক পূণরায় যখন উক্ত নূরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তখন ইহা আল্লার ভয়ে লজ্জিত ও ঘর্মাক্ত হইয়া যায়। আল্লাহ পাক তাঁহার মাথার ঘর্ম হইতে ফেরেশতাদিগকে এবং মুখমন্ডলের ঘর্ম হইতে আরশ-কুরসি, লৌহ-মাহফুজ, কলম, চন্দ্র, সূর্য, পর্দাসমূহ, তারকারাজি এবং আকাশস্থিত যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করেন।...........
একমাত্র চক্ষুষ্মান ব্যক্তির পক্ষেই উপরোক্ত হাদিসের মর্ম বুঝা সম্ভব। আত্মচক্ষু যার খোলা আছে তার পক্ষে আলোর উৎস খোঁজা ও বুঝা যেমন কঠিন নয়, তার জন্য তেমন কঠিন নয় জ্ঞানের মহাসাগরের ডুব দেয়াও। এই অনন্ত মহাসাগর হাতড়ে যারাই ঝিনুক কুড়াতে পারে তারাই সার্থকজন।
পরিশেষে, গীতাঞ্জলি থেকে রবী ঠাকুরের 'কোথায় আলো' শুরুর কবিতার শেষাংশ দিয়ে যবনিকা টানছি—
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১ মে, ২০২১.