রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০২১

সাবধান মুসলমান!


পবিত্র কোর'আনুল কারীম নিয়ে প্রথম ব্যবসা শুরু হয়েছিল সিফফিনের যুদ্ধে— তলোয়ারের আগায় কোর'আন বেঁধে ধোঁকার মাধ্যমে; যা আজও অব্যাহত। বরং পরিসর বেড়েছে অনেক, হাজার-কোটিগুণ; তারাই ইসলামকে বানিয়েছে আজ পোশাকি ধর্ম। আদর্শ ও মতবাদের বৈপরীত্য, আর আলেম সমাজের মত ও পথের বিভিন্নতায় বিশ্ব মুসলিম ঐক্যসূত্র আজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে; এ যেন এক অতল মহাসাগর। এই দীর্ঘ জীবনে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় প্রত্যেক দলের ধর্মীয় বিশ্বাস বেশ ভালো করেই পরীক্ষা করেছি; আবিষ্কার করেছি তাদের গলদ আকিদা। আবার তারাই 'লাইলাতুল নিফসে মিন সাবান' পালনকারীকে অপবাদ দেয় 'বেদাতী' বলে, মাজার জেয়ারতকারীকে অপবাদ দেয় 'কবর পূজারী' বলে! বাপ-দাদারা তো ওসব পালন করতেন; তবে কি তাঁরা সবাই জাহান্নামী?(নাউজুবিল্লাহ!) তোমরা এ'সব নতুন কথা, নতুন বাহানা, নতুন ফেতনা কোথায় পেলে? 

সাধারণ মুসলমান এখন যাবে কোথায়? তারাও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে; বিভিন্ন মতে চায়ের দোকান দাবিয়ে বেড়াচ্ছে! ভার্চ্যুয়াল এই যুগে এসে ভ্রান্ত মোল্লারা সব এখন মিডিয়ার মাঠ দখল করে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে ব্যতিব্যস্ত। আর তাই, সাধারণ মুসলমানরা ভ্রান্তদের মতবাদের অতল গহ্বরে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে; অনেকেই এই মহাসাগরে তলিয়েও গেছে, আবার কেউবা নাক ডোবা-ভাসা অবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছে। মহাসাগরে ডুব দিয়ে ঝিনুক কুড়ানো যতটা কঠিন, আর চেয়েও বেশী কঠিন বিভ্রান্তির এই মহাসাগরে ডুবে জ্ঞানের আলোকে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কিতাব 'এহইয়াউল উলুমুদ্দীন'-এ স্পষ্টতই আমাদের জন্য দিক নির্দেশনা রেখে গেছেন— 'একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত-ই হলো  নাজাত প্রাপ্ত দল' বলে।

বর্তমানের এই লোভাতুর কামার্ত বস্তুবাদী দুনিয়ায় যে কোন মুসলমানের পক্ষে সত্য পথ ধারণ এবং অবলম্বন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, হারাম এখন আমাদের রক্তে-মাংসে মিশে গেছে; হারাম উপার্জিত পয়সা দিয়ে মসজিদ মাদ্রাসা করে, মোল্লা বানিয়ে, হজ্জ করে, নামাজ পড়ে লাভ কি? তাই তো এতো এতো বয়ান শোনার পরও মানুষের জীবনযাপনে কোর'আন-হাদিসের কোন আসর পরিলক্ষিত হয় না; বরং দিনদিন সত্য থেকে মুসলমান যোজন-যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। মিথ্যা ও হারামের জন্যই আজ মানুষের মাঝ থেকে হেদায়েতের নূর উঠে গেছে, সিরাতুল মোস্তাকিমের পথ খোঁজা ও সন্ধান কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পথে হাঁটা ও সার্থক হওয়া ভাগ্যবানের সংখ্যা তাই দিন দিন অতি নগন্য হয়ে পড়ছে। 

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো— বাতিলরা প্রত্যেকেও নিজেকে সার্থক ও সিদ্ধ মনে করে! আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত-ই তো বলেছেন, 'প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদে খুশি '। এসব মতবিরোধ ও মতবাদ সম্বন্ধে হুজুরপাক (সাঃ) সারে চৌদ্দশ বছর আগেই ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন, 'আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে; তন্মধ্যে একদলই শুধু মুক্তি পাবে।'  

দুনিয়ার ক্ষমতার জন্য যারা খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত আলী (রাঃ)-র বায়াত নিতে  তালবাহানা করেছিল, কারবালার প্রান্তরে যারা ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল, তারাও নামাজ পড়তো, তাশাহুদ শেষে দুরুদ পড়তো, রোজা রাখতো, লম্মা জুব্বা পড়তো। তাদের অনুসারীরা আজও দুনিয়াতে অধিক পরিমাণে আছে; বস্তুত ওরাই সংখ্যায় অধিক! নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা দুনিয়াটাকে জাহান্নাম বানাতে ব্যতিব্যস্ত। এ'সব মুনাফেক থেকে সাবধান মুসলমান।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৮ মার্চ, ২০২১.

রবিবার, ২১ মার্চ, ২০২১

রূহ্ এবং নফস:


আমরা অনেকেই রূহ্ ও নফস্-কে একই মনে করি; আসলে এ'দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, একই বস্তু নয়। 'রূহ্' হলো পরমাত্মা, আর 'নফস' হলো জীবাত্মা (মন বা ইগো বা জীবনীশক্তি)।  সুরা সোয়াদ-এর ৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, 'ফাইযা-সাওয়্যাইতুহূ ওয়া নাফাখ্তু ফীহি মির রূহ্বী ফাক্বাউ লাহূ সা-জ্বিদীন।'- অর্থাৎ, 'যখন আমি ওকে সুঠাম কবর এবং ওতে রূহ্ সঞ্চার করব তখন তোমরা ওর প্রতি সিজদাবনত হও।' এবং সূরা বনী ইসরাঈল-এর ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেন,'ইয়াস্আলূনাকা ‘অনির্ রূহ্বি; কূলির রূহ্ব মিন্ আমরি্ রাব্বী ওয়ামা~ ঊতীতুম্ মিনাল্ ‘ইলমি ইল্লা-ক্বালীলা।' - অর্থাৎ- 'তোমাকে ওরা রূহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করে; বল, ‘রূহ আমার রবের আদেশঘটিত, এ বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।' 

পবিত্র কুর'আনুল কারীমে অন্তত বিশবার ‘রূহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং তিনটি প্রসঙ্গে এ শব্দটি উদ্ধৃত হয়েছে। প্রথমতঃ ‘রূহ’ মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা বুঝাতে এসেছে; দ্বিতীয়তঃ ‘রূহ’ শব্দটি ওহীর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা হযরত জিব্রাইল (আঃ) প্রসঙ্গে এসেছে; এবং তৃতীয়তঃ ‘রূহ’ শব্দটি এসেছে স্বয়ং কুরআন ও আল্লাহর ওহী সম্পর্কে, যে ওহী রাসূলপাক (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ। সহজভাবে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় - 'রূহ' হলো প্রাণ; কিন্তু কোন প্রাণ? যে তিনটি প্রসঙ্গে এই ‘রূহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের জীবন এবং মানব প্রাণের উৎস হিসেবে রূহ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে।

অতএব, আমরা এখন মোটামুটিভাবে এমন একটি সিদ্ধানে উপনীত হতে পারি যে, 'আররূহ্ব আমরূল্লাহ্' অর্থাৎ- রূহ্ হলো আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার নির্দেশ বা হুকুম। আর আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার হুকুম-এর কি কখনো মৃত্যু হওয়া সম্ভব? –কখনো নয়। তাই তো বলি - রূহের মৃত্যু নেই; যা চীরস্থায়ী। স্রষ্টার সৃষ্টির স্থায়ীত্বের ভিত্তি - ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘস্থায়ী ও চীরস্থায়ী-র উপর নির্ভর করেই  সবকিছু সৃষ্টি এবং প্রবর্তিত হয়, হবে। স্রষ্টার সৃষ্ট প্রতিটি বস্তুরই মৃত্যু আছে; এক সময় না এক সময় সব কিছুই মরে যায়, যাবে বা ধ্বংস হবে; কিন্তু চীরস্থায়ী রূহ বা পরমাত্মার কখনো মৃত্যু বা বিনাশ হবে না, নেই।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে মানুষ মরে যায় কেন বা তা হলে মরে কি? মারা যায় আসলে মানুষের নফস বা জীবাত্মা বা জীবনীশক্তি; অর্থাৎ জীবন বা মন। মানুষের 'রূহ্' কখনো মরে না বা মরবেও না।  নফসের জীবনীশক্তি দেহের প্রতিটি রন্দ্রের সবখানেই বিরাজিত থাকে, এবং তা এক সময় মরে যায়। নফস বা জীবাত্মা আবার তিন প্রকার; যথা- ১). নফসে আম্মারা, ২). নফসে লাউয়ামাহ, ও ৩). নফসে মুতমাইন্নাহ্। পবিত্র কুর'আনুল কারীমের সূরা ইউসুফ-এর ৫৩ নম্বর, সূরা কিয়ামাহ-র ২ নম্বর ও সূরা ফাজর-এর ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। একটু মনযোগ ও আন্তরিকতার সাথে খেয়াল করলেই হয়তো আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা আপনাকেও এ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দিতে পারেন।

পবিত্র কুর'আনুল কারীমে সুরা আম্বিয়া-র ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা স্পষ্টই বলেন, ' কুল্লু নাফ্সিন যা-ইক্বাতুল্ মাওত।" অর্থাৎ প্রত্যেক নফসই (জীব) মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।' মৃত্যুর স্বাদ বলতে এখানে আসলে কি বুঝানো হয়েছে? এখানে বুঝানো হয়েছে শান্তি বা শাস্তির কথা। সকল নফস-কেই শান্তি বা শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হয় বা হবে। তা দেহ ধারণের আগেই হউক বা দেহ ধারণের পরেই হউক বা দেহ ত্যাগের পরে হউক। তিন অবস্থাতেই নফস বা জীবাত্মা শান্তি বা শাস্তি ভোগ করে বা করবে। রূহ কখনই শাস্তি ভোগ করে না বা করবে না; রূহ নফসের শাস্তির ভাব প্রকাশ করে মাত্র। রূহ শাস্তি ভোগ করার অর্থ দাঁড়ায় স্রষ্টা নিজে শাস্তি ভোগ করা; যা কখনো সম্ভব নয়, হতে পারে না। 

মানবদেহে একমাত্র রূহই হলো আল্লাহর প্রতিনিধি; যা মানবদেহের মহারাজ। যে রূহ বা পরমাত্মা আল্লাহর তাজাল্লী বা আদেশ, তার ভুল-ত্রুটি কী করে সম্ভব? যেহেতু রূহ-র মৃত্যু নেই, সুতরাং তার কোনো শাস্তিও নেই। 

না বুঝে সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি অনেক জ্ঞানীগুণীজণও অনেক সময় ভুল করে বসেন এবং ভাবেন - রূহই আত্মা, ও নফসও আত্মা বা রূহ্ ও নফস একই। 'রূহ্ব' ও 'নফস' আরবি শব্দ দু'টির বাংলা অর্থ লিখার সময় একশ্রেণির পীর, আলেম-মৌলোভী ও তাফসীরকারক খেয়াল না করে আত্মা বলে একই অর্থ করে ফেলেন। আসল কথা হলো, আত্মা বলতে যদি নফস বুঝানো হয় তাহলে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে; আর আত্মা বলতে যদি রুহও বুঝানো হয়, তাহলে তা-কেও শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু কোনভাবেই রূহ কখনো শাস্তির উপযুক্ত নয়; কেননা, এ যে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলার তাজাল্লী। 

অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা মৃত্যুর পর তো দেহ থাকে না, তাহলে রূহকেই দুনিয়ার অপকর্মের শাস্তি ভোগ করতে হয় বা হবে। সত্যিকার অর্থে ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয় বা তা না; কারণ দেহ ধারণ ছাড়া রূহ-কে অনুভব করা কখনো সম্ভব নয়। রূহকে কোন ভাবে কারো পক্ষে বাধ্যও করা সম্ভব নয়। দেহ না থাকলে রূহ কখনই তাতে বসত করে না বা করতে পারে না। এজন্য মায়ের গর্ভে শিশুর দেহ জীবনীশক্তিসহ আগেই তৈরি হয়; এবং ৪ মাসের সময় সেই দেহের মাঝে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার তরফ হতে রূহ নাযিল হয়। আসলে, মানবদেহের জীবনশক্তি হলো নফস বা জীবাত্মা; আর রূহ বা পরমাত্মা হলো আল্লাহর অংশ, যা তাঁর ফুঁ বা হুকুম।

রূহ এবং নফস আসলে একে অপরের পরিপূরক এবং ওরা একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িতও। বান্দা নেককাজ বেশি বেশি করলে রূহ ও নফস একাকার হয়ে যায়, আর বদকাজে নফস থেকে রূহ দূরে সরে যায়। তবে, প্রধান ও প্রথম শর্ত হলো খাঁটি ঈমান। অতঃপর রূহ-কে সচল রাখতে হলে সর্বাবস্থায় স্মরণ করতে হবে সুরা তাকাছুর-এর উক্ত দু'আয়াত- 'আল্হা-কুমুত তাকা-ছুর, হ্বাত্তা- যুরতুমুল্ মাক্বা-বির।' অর্থাৎ- 'প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের ভুলিয়ে রেখেছে, যদিও তোমরা কবরের সন্মুখীন হও।'

রূহ চায় আল্লাহ্-র তুষ্টি, কিন্তু নফস চায় আরাম-আয়েস ভোগ-বিলাস। নফস-কে জয় করতে হলে অবশ্যই অসম প্রাচুর্যের লোভ-লালসা সম্ভরণ করতে হবে, এবং আমাদের মাঝে বসবাস করা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'লার অংশ রূহ-কে সার্বক্ষণিক প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করতে হবে; তবেই আসবে অনন্ত সাফল্য॥

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২১ মার্চ, ২০১৯.