এটা করা যাবে না - ওটা করা যাবে না, বর্তমানের এই ডিজিটাল ভার্চুয়াল যুগে এসে মানুষের কত ভিন্ন মত, কত ভিন্ন পথ, কত ভিন্ন বিচিত্রতা আজ মুসলমানের ঘরে ঘরে; উৎসবের কথা বাদই দিলাম, ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিষয় নিয়েও এখন রাস্তা ঘাটে ঘরে বাইরে সমাজের সর্বত্র চলছে সব কিছু নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি। তাই, অনেকেই মনে করেন এবং কেউ কেউ বলেও বসেন - একমাত্র ইসলামেই সবচেয়ে বেশি বিভক্তি। কিন্তু কেন যেন আমি তাদের এই কথাটি মোটেও মেনে নিতে পারি না। কারণ আমি মনে করি, মতের ভিন্নতা কখনো ধর্মের বিভক্তি হতে পারে না; তাছাড়া মতের ভিন্নতায় কারো কিছু যায় আসেও না; মৌলিক বিষয়গুলোতে এক থাকলেই চলে। প্রকৃতপক্ষে, ধর্ম বিভক্তি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস; যেমন - খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ইত্যাদি।
দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মের প্রতিটি মানুষের মাধ্যেই মতভেদ ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু অন্যান্য সব ধর্মের লোকদের মাঝে মানুষ এবং মানবতার প্রশ্নে এবং ধর্মীয় কিছু মৌলিক বিষয়ে একটা ঐক্যমত্য আছে; বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে যা খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। তাই কারো কারো কাছে হয়তো মনে হতেও পারে ইসলাম ধর্মে বেশি গ্যাঞ্জাম; আসলে কিন্তু মোটেও তা না। অবশ্যই এই কথাটি প্রতিটি মুসলমানের স্মরণ রাখা উচিত - মুত্তাকী মুসলিমের মধ্যে কোন ভাগ বা বিভক্তি নেই; তাঁদের সবার মত ও পথ এক ও অভিন্ন। শুধু বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা খাঁটিয়ে অন্তরচক্ষু খুলে দেখতে পারলেই বুঝতে পারা যায় ইসলাম কত সহজ, কত সরল, কত সুন্দর ও কত পরিচ্ছন্ন।
ইসলাম ( الإسلام) শব্দটি এসেছে আরবি س-ل-م হতে; যার দু'টি অর্থ - ১. শান্তি; ও ২. আত্মসমর্পণ। সংক্ষেপে, ইসলাম হলো শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্-র কাছে আত্মসমর্পণ। আর মুসলিম (مسلم-) অর্থও সেই 'আত্মসমর্পণ'। অনুগত হলো সেই ব্যক্তি যিনি নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহ্-র কাছে সম্পূর্ণরুপে আত্মসমর্পণ করেন। মুসলিম শব্দটি মূলতঃ সালাম শব্দ হতে উদ্ভূত। যার শাব্দিক অর্থ হলো - শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। এক কথায় মুসলিম শব্দের পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো - আত্নসর্মপনকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলার কাছে সম্পূর্ণরুপে আত্মসমর্পণ করেন, তাঁর কোন ভয় নেই; তিনি-ই প্রকৃত মুসলিম। আর মুত্তাকী হলেন আল্লাহ পাকের ঐ সকল বান্দা, যাঁদের অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয় আছে এবং যাঁরা গুনাহ্ থেকে সব সময় বেঁচে থাকেন।
সার্বিক এবং পারিভাষিক অর্থে সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিনকে মহান প্রতিপালক হিসেবে গ্রহন করবেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেন না এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশিত পথে নিজের জীবন চালাবেন, হালাল কে হালাল বলে মানবেন এবং হারামকে প্রচন্ডভাবে বয়কট করবেন, সালাত প্রতিষ্ঠা করবেন, রোজা রাখবেন, নিসাবের অধিকারী হলে অবশ্যই যাকাত আদায় করবেন এবং সামর্থবান হলে হজ্জে গমন করবেন, এইসব গুনাবলী একজন মানুষের মাঝে বিদ্যমান থাকলেই মোটামুটিভাবে তাঁকে মুসলিম বলা যাবে; অন্যথায় নয়।
কিন্তু এ'সব বাদ দিয়ে বর্তমান জামানায় সমাজে বিভিন্ন সব শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে, যারা অযথাই ভিন্ন মত ও পথের সৃষ্টি করে চলছেন। মুসলিমের ঘরে জন্ম নেয়ার অধিকারে ইসলামের মৌলিক সব বিষয় বাদ দিয়ে বা উপেক্ষা করেও দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ অন্য সবাইকে নাস্তিক বলছেন! অরেক দল ইমান ও আমলকে উপেক্ষা করে উঠেপড়ে লেগেছেন জিহাদ করতে। এবং অন্য আরেক দল নিজেদের মধ্যে মুসলমানিত্ব প্রতিষ্ঠা না করে রাষ্ট্রকে মুসলমান বানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন! অবশ্য মুসলমানের মধ্যে এইসব মতভেদ নতুন কিছু নয়, ইসলামের সেই প্রাথমিক যুগ থেকেই ছিল এবং থাকবেও। অবশ্য ইয়াজিদের শাসনামল থেকে এসব প্রচন্ড ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল।
এসব কিছু বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের জানা উচিত ধর্ম বা Religion জিনিসটা আসলে কি? উইকি-র সজ্ঞানুসারে বলা যায় ধর্ম হলো লিপিবদ্ধ সুবিন্যস্ত প্রত্যাদেশসমূহ, যেগুলো সাধারণত ঈশ্বর-প্রত্যাদিষ্টদের মাধ্যমে বাহিত ও প্রচারিত; ঈশ্বরাজ্ঞা ও ধর্মানুষ্ঠান-নির্ভর আচার; আচরণ ও প্রথা সমূহের প্রতি বিশ্বাস-নির্ভর আনুগত্য; যা সাধারনত 'আধ্যাত্মিক' ব্যাপারে 'দৃঢ় বিশ্বাস'-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত, এবং বিশেষ পূর্বপুরুষ হতে প্রাপ্ত ঐতিহ্য, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা, রীতি-নীতি ও প্রথাকে মানা এবং সে অনুসারে মানবজীবন পরিচালানা করা। অতএব, যুগের পরিক্রমায় মতভেদ তো থাকবেই। তবে যারা মানব ইতিহাসের সঠিক ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে চলেন বা চলতে পারেন তাদের ভুল হওয়া বা তাদেরকে ভুল পথে পরিচালনা করা কঠিন। আসলে ধর্ম হলো জীবন চালানোর ও সুন্দর করার একটি সহজ মত ও পথ।
হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে অদ্যবদি পৃথিবীর সমগ্র মানব ইতিহাসের দিকে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে এবং সঠিকতার দিক দিয়ে একটু গভীর ভাবে একান্তে চিন্তা করলেই স্পষ্ট বুঝা যায় - মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য কোন মানুষ নয়; আর মানুষের জন্যই মানবতা, মানুষ মানবতা ও ধর্ম নিয়ে কোন বিবাদ বা বাড়াবড়ি নয়। কিন্তু দেখা যায় কিছু আদম সন্তান সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই সব সময় সব বিষয়ে সব কিছুতেই বিকৃতিতে তৃপ্ত অনুভব করতে চেয়েছে বা চায় এবং কাল কিয়ামত পর্যন্তও চাইবেও। তাই, সঠিকটা প্রত্যেকের নিজ প্রচেষ্টায়ই খুঁজে বের করা উচিত এবং তদানুযায়ীই চলা উচিত। দেখেন ভাই, কয় দিনেরই-বা এই জীবন? এক জীবনে একজন মানুষের কতটাই-বা চাহিদা? একজন মানুষ তার সারা জীবনে কতটাই-বা ভোগ করতে পারে? অতএব, একটু বুঝে শুনে চললেই সব কিছু সহজ হয়ে যায়।
দেখতে দেখতে ১৪৩৮ হিজরি চলে গেল এবং ১৪৩৯ হিজরিও এসে পড়ল, সামনে আসছে পবিত্র আশুরা। দেশের আকাশে এরই মধ্যে ১৪৩৯ হিজরি সনের পবিত্র মুহাররম মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ফলে গত শুক্রবার ২২ সেপ্টেম্বর থেকে পবিত্র মুহাররম মাস গণনাও শুরু হয়ে গেছে, আগামী ১ অক্টোবর পবিত্র আশুরা। কেন যেন আজ হটাৎ সেই ৬১ হিজরির ১০ মুহাররম সংগঠিত কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনাটি খুবই লেখতে ইচ্ছে করছে, তাই আজ আশুরা বা ১০ মুহাররম নিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু লিখবো ভাবছি, যদি তা করো কোন কল্যাণে আসে।
উম্মতে মুহাম্মদী অর্থাৎ আমাদের জন্য আশুরা মূলতঃ একটি শোকাবহ দিন। কেননা, এই দিনে আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী দো'জাহানের বাদশাহ্ আল্লাহ্-র হাবীব হুজুর পাক হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহাম্মদ মুস্তবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রাদি'আল্লাহু আনহু-র শাহাদাত বার্ষিকী; কারবালার প্রান্তরে ফোরাতের তীরে নির্মমভাবে তাঁকে এই দিনে শহীদ করা হয়েছিল। কিন্তু সৃষ্টি তত্ত্বগত ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় এই দিনটি বিভিন্ন কারণেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও অতীব গুরুত্ববহ।
সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এই দিনটি একটি অত্যন্ত পবিত্র দিন। কেননা, ১০ মুহাররম আল্লাহ্ রাব্বুল আ'লামিন সমগ্র আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছিলেন। এবং এই দিনেই পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনেই আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীদের স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছিলেন; হযরত মুসা (আঃ)-এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, হযরত নূহ (আঃ)-এর কিস্তি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং তিনি জুডি পর্বতশৃংগে নোঙ্গর ফেলেছিলেন, হযরত দাউদ (আঃ)-এর তাওবা কবুল হয়েছিল, নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) উদ্ধার পেয়েছিলেন, হযরত আইয়ুব (আঃ) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন, আল্লাহ তা'আলা হযরত ঈসা (আঃ)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে, এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় ৬০ হিজরি সনে পিতার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামিক চিন্তাবিদের মতে, ইয়াজিদ মুসলমান ছিল না, সে ছিল সর্বস্বীকৃত একজন মুনাফেক। এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে মদ্যপানকেও সে মুসলমানের জন্য বৈধ বলে ঘোষণা করেছিল। অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাকেও বৈধ বলে ঘোষণা করেছিল। শাসক হিসেবে সে এতোটাই স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী ছিল যে, যা বলা বাহুল্য। মসজিদে নব্ববীকে সে ঘোড়ার আস্তাকুঁড় বানিয়েছিল।
ঐতিহাসিক আল-ফাখরী, ফন ক্রেমার ও ইবনুত তিকতাকা-র মতে ইয়াজিদের রাজত্বকাল তিনটি দুষ্কর্মের জন্য বিখ্যাত; ১. প্রথম বছরে সে মহানবী (সাঃ)-এর আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হত্যা করে, ২. দ্বিতীয় বছরে মদীনা লুন্ঠন করে, এবং ৩. তৃতীয় বছরে সে কাবার উপর হামলা করে।
ইয়াজিদের মতো এমন বিকৃত মুনাফেকের ক্ষমতা গ্রহণের পর হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যুক্তিযুক্ত কারণেই তার আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। বলতে গেলে সেই সময় অর্থাৎ উমাইয়া শাসনামলে ইসলাম সম্পূর্ণরুপে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল। মক্কা থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) প্রথম কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা শরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে না গিয়ে কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঐ সময় উমর ইবনে সা'দ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে ইয়াজিদের চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে। এর কয়েক ঘণ্টা পর শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।
ইয়াজিদের বিশাল এই সৈন্য দল ও হযরত ইমাম হুসাইন (রঃ)-র ছোট্ট সফরকারী দল কারবালায় মুখোমুখি অবস্থান নেয়। নানান নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষমেশ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেই অসম যুদ্ধে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এবং তাঁর ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন। শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদরের প্রাণপ্রিয় নাতি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করে। সে দিনটি ছিল ৬১ হিজরীর ১০ই মুহাররম। তাই এই দিনটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখের।
সবার জানার জন্য ঘটনাটি এখন কিছুটা বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি। ৬৮০ ইসায়ী খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-এ হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কর্তৃক ইসলামে নিষিদ্ধ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা ঘোষণা করা হয়। খলিফা হয়েই ইয়াজিদ মদিনার গর্ভনরকে তাৎক্ষণিকভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য (বায়াত) আদয়ের জন্য নির্দেশ জারি করে। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, তিনি মনে করতেন যে, ইয়াজিদ ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গেছে এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সুন্নাহকে অনেক পরিবর্তন করছে। তাই হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) তাঁর পরিবারের সদস্য, সন্তান, ভাই এবং হযরত ইমাম হাসান (রাঃ)-এর পুত্রদের নিয়ে মদিনা থেকে মক্কায় চলে যান।
অপরদিকে কুফাবাসী যারা হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-র মৃত্যু সম্পর্কে অবগত ছিলেন তারা চিঠির মাধ্যমে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে অনুরোধ করেন এবং উমাইয়াদের বিপক্ষে তাঁকে সমর্থন প্রদান করেন। প্রত্যুত্তরে ইমাম হুসাইন চিঠির মাধ্যমে জানান যে অবস্থা পর্যবেক্ষনের জন্য তিনি তাঁর আত্মিয় মুসলিম ইবনে আকীল-কে পাঠাবেন। যদি তিনি তাদের ঐক্যবদ্ধ দেখতে পান যেভাবে চিঠিতে বর্ণিত হয়েছে সেরুপ, তবে খুব দ্রুতই তিনি যোগ দিবেন। কারণ একজন ইমামের দায়িত্ব হচ্ছে কুর'আন বর্ণিত অনুসারে কাজের আঞ্জাম দেওয়া, ন্যায়বিচার সমুন্নত করা, সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজেকে স্রষ্টার নিকট সঁপে দেওয়া।
মুসলিম ইবনে আকীল-এর প্রাথমিক মিশন খুবই সফল হয়েছিল এবং ১৮০০-র অধিক ব্যক্তি শপথও প্রদান করেছিলেন। কিন্তু অবস্থা ইতিমধ্যে পরিবর্তন হয়ে যায়। উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কুফার নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ দেয় এবং সে মুসলিম ইবনে আকীল-কে হত্যার নির্দেশ জারি করে। হযরত আকীল-এর মৃত্যুর খবর পৌঁছার আগেই হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে দেন।
কিন্তু পথিমধ্যেই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) খবর পান যে হযরত আকীল-কে কুফায় হত্যা করা হয়েছে। তিনি তৎক্ষনাৎ খবরটি তাঁর সমর্থকদের জানান এবং তাদের বলেন, জনগণ তাঁর সাথে প্রতারণা করেছে। তিনি কোন সংশয় ছাড়াই তাঁর সাথীদের তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে বলেন। এবং অধিকাংশ সঙ্গীসাথী তাঁকে ছেড়ে চলেও যায়, শুধুমাত্র ২০০ জন নিকটাত্মীয়রা ছাড়া; যাই হউক, কুফার যাত্রাপথে এরই মধ্যে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের সাথে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে মোকাবেলাও করতে হয়।
কুফাবাসীগণ ইমামবিহীন থাকার কারণে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে তারা আমন্ত্রণ করেছিল, সে প্রতিশ্রুতির কথা তিনি কুফার সেনাবাহিনীকে স্মরণ করতে বলেন। তিনি বলেন যে, কুফাবাসী সমর্থন করেছিল বলেই তিনি যাত্রা করেছেন। কিন্তু তারা যদি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর আগমনকে অপছন্দ করে, তবে তিনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই চলে যাবেন। তবে সেনাবাহিনী হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে অন্য পথ অবলম্বন করতে বলে। এতে করে তিনি (হুসাইন) বাম দিকে যাত্রা শুরু করলেন এবং কারবালায়ও পৌঁছে গেলেন। সেনাবাহিনী তাঁকে এমন এক জায়গায় অবস্থান নিতে বাধ্য করলো যে জায়গাটি ছিল পুরোপুরি পানিশূন্য।
সেনাপ্রধান উমার ইবনে সা'দ হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-র আগমনের উদ্দেশ্য বুঝার জন্য সেখানে দূত প্রেরণ করে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) জানালেন যে তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে এসেছেন, কিন্তু তারা যদি অপছন্দ করেন, তবে তিনি ফিরে যেতে প্রস্তুত রয়েছেন। যখন এই প্রতিবেদন ইবনে জিয়াদের কাছে পৌছে তখন সে সা'দকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর সমর্থকদের ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রদানের নির্দেশ দেয়। সে আরো নির্দেশ দেয় যে, হযরত হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা যাতে কোন পানি না পায়।
পরের দিন সকালে উমার বিন সা'দ তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলে। আল হুর ইবনে ইয়াজিদ আল তামিম সা'দের দল ত্যাগ করে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-র সাথে যোগ দেন। তিনি কুফাবাসীদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নবী কারীম (সাঃ)-এর নাতীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অন্যদের ভৎসনা করেন এবং যুদ্ধে তিনি নিহত হলেন। কারবালার যুদ্ধ সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দিনটি ছিল ১০ অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ তথা ১০ মুহাররম ৬১ হিজরি; এই অসম যুদ্ধে মহানবী (সাঃ)-এর নিকট আত্মিয় প্রায় ৭২ জন নিহত হন, যাঁদের সকলেই পানি বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। সকল পুরুষ সদস্যই সেদিন সেখানে নিহত হয়েছিলেন, কেবলমাত্র রোগা ও দুর্বল হযরত জয়নুল আবেদিন (রাঃ) ছাড়া।
এটি এমন একটি অসম যুদ্ধ ছিল যে সেখানে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর পরিবার ইয়াজিদের বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবনিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবু রায়হান আল বিন্নী-র মতে, “তাবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং মৃতদেহগুলোকে ঘোড়ার খুড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত ও পদদলিত করে দেয়া হয়েছিল; মানব ইতিহাসে এর আগে কেউ কখনো এমন নৃশংসতা দেখেনি। হত্যার আগমুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন বলেন, 'আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যদি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কষ্টের দ্বীন জীবন্ত হয়, তবে আমাকে তরবারি দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলো।'"
উমাইয়া সৈন্যরা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর পুরুষ সঙ্গীদের হত্যা করার পর সমস্ত ধন সম্পদও লুট করে নেয়, গলা থেকে মহিলাদের গয়নাও কেড়ে নেয়। শিমার হযরত জয়নাল আবেদীনকে হত্যা করতে চাইলে হযরত জয়নাব বিনতে আলী-র প্রচেষ্টায় কমান্ডার উমার ইবনে সা'দ তাঁকে জীবিত রাখে। হযরত জয়নাল আবেদীন-কেও বন্দী নারীদের সঙ্গে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। মোটামুটি ভাবে এই হলো কারবালার সঠিক ও সংক্ষিপ্ত করুণ ইতিহাস, যা আমি ইসলামের ইতিহাস ও বিভিন্ন উইকি-র তথ্য দিয়ে সাজিয়েছি।
আজকের দুনিয়বাসীরা ১০ মহাররম এলে অনেক জাতি অনেক কিছু করে; ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে মুহাররমের ১০ তারিখে রোজা রাখে, শিয়া সম্প্রদায় মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটিকে উদযাপন করে; আরো কত কি আমাদের মুসলিম সমাজেও প্রচলিত!
কিন্তু, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে উল্লেখ আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।"
أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭
এর মধ্যে আশুরা বা ১০ মহাররমের রোযার ফযীলত অনেক বেশি। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা যাঁদেরকে খাস রহমত দান করেছেন সেই সব মুসলমানের জন্য সুন্নাত হলো আশুরা উপলক্ষে ৯ এবং ১০ মুহাররম তারিখে অথবা ১০ এবং ১১ মহাররম তারিখে অন্ততঃ দুটো রোজা রাখা; কারণ, ইহুদিরা একটি রোজা রাখে। আশুরা উপলক্ষে সুন্নি মুসলমানরা সেই আগের জামানা থেকেই সাধারণত ২-৩ টি নফল রোজা রাখতেন এবং যথাযথ মর্যাদার সাথে নফল নামাজ ও দোওয়া দরুদ করে দিনটি পালন করতেন, এবং এই দিনে সবাইকে নিয়ে উত্তম আহার করতেন।
আজ এই মহা ফেতনার যুগে এসে সারা বিশ্বের ইমানদার মুসলমানরা যেন ঠিক সেই ফোরাতের তীরের অসহায় হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কারোরই যেন কিছু করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কেন? বিকৃত তথাকথিত ইসলামিক মাল্টি মিডিয়া গ্রুপ ও ফুটপাতের ক্যানভাসার সদৃশ ধার্মীক গ্রুপের পাল্লায় পড়ে আবার যেন কোন মুমিন মুসলমান তাঁর মহা মূল্যবান সম্পদ 'ইমান' হারিয়ে না ফেলেন; বরং ইমানি শক্তিতে বলিয়ান হয়ে 'আল্লাহু আকবার!' বলে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হউন এবং সকল মিথ্যার সাথে জিহাদ করুন।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৯ সেপ্টম্বর ২০১৭.