ইসলামের সকল বিধিবিধানের মৌলিক উৎস চারটি— কুর'আন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস; এই চারটি মূল উৎস ছাড়া কোন ইসলামিক বিধিবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব নয়, অবশ্য এইসব মৌলিক উৎস ছাড়াও অন্যান্য কিছু উৎস রয়েছে। ইসলামিক আইনের মূল ভিত্তি ও উৎস হলো পবিত্র কুর'আনুল কারীম। বেশিরভাগ আইনের ক্ষেত্রেই পবিত্র কুর'আনে সংক্ষিপ্ত মৌলিক আলোচনা করা হয়েছে; যেমন, পবিত্র কুর'আনে নামাজ ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে, কিন্তু এগুলোর সময়, পরিমাণ ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। যেসব বিষয়ে পবিত্র কুর'আনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি সেগুলো জানার জন্য হাদিসের সহায়তা নিতে হয়।
ইজমা অর্থ হলো ঐকমত্যে পৌঁছানো; ইসলামি পরিভাষায় ইজমা বলা হয়— কোন বিষয়ে ইসলামি আইনবিদগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে। এই ঐকমত্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম-এর মৃত্যু-পরবর্তী যে কোন সময় বা যুগেই হতে পারে। ইসলামি আইনের উৎস হিসেবে ইজমার অবস্থান হাদিসের পরে। ইজমা শরীয়তের মৌলিক উৎস হওয়া পবিত্র কুর'আন ও হাদীসের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত বিধান সমূহের একটি হলো, মৃতব্যক্তি শুধুমাত্র পিতা ও এক সন্তান রেখে মারা গেলে সম্পত্তি বন্টনের বিধান।
কিয়াস হলো দুইটি বিষয়ের বাহ্যিক বা অর্থগত সামঞ্জস্য বিধান; অর্থাৎ এমন নতুন বিষয় যার বিধান কুর'আন-হাদিসে নেই, কিন্তু তার মতো অন্য আরেকটি বিষয়ের বিধান সেখানে আছে। তখন কুর'আন-হাদিসে উল্লেখিত বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য থাকার কারণে অনুল্লেখিত বিষয়ের সমাধান সেখান থেকে আহরণ করা হয়। কিয়াসের অবস্থান ইজমার পরে।
উক্ত চারটি বিষয়ের উপর পান্ডিত্বের অধিকারী ব্যক্তিকে বলা হয় ফকিহ। আর ফকিহ এসেছে ফিকাহ থেকে। ফিকাহ-ই হলো ইসলামী আইনশাস্ত্র; যা অধ্যয়নের মাধমে মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনের সকল বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান তৈরী করা হয়।
পৃথিবীতে এখন আর ফকিহ-র অভাব নেই; ইহুদী নাসারা-রাও মুসলিম ফকিহ সাজে। ব্রিটিশরা একসময় মুলিমদের মাঝে ফকিহ বানাতো; দুনিয়াবী কর্তৃত্ব হাসিলে ওদের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে অনেকেই ফকিহ হতো, হয় এবং হচ্ছে। এমন অনেক ইতিহাস পাক-ভারত উপমহাদেশে অহরহ দেখা যায়। এসব আলেম নামের জালেমরাই আজ আমাদের ইসলামী জীবনকে, সমাজকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে ঠেকিয়েছে।
শান্তির ধর্ম ইসলাম, সৌহার্দের ধর্ম ইসলাম, সম্প্রীতির ধর্ম ইসলাম; অথচ সারা বিশ্বে মুসলিমরা আজ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারছে না, এক আলেম আরেক আলেমকে মূর্খ বলে বিচ্ছিরিভাবে গালাগালি করছে, যা বলা বাহুল্য। সেই ছাপ পরেছে আজ পুরো উম্মতে মুহাম্মদীর উপর। এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে সন্দেহ করছে, কারো কথাই কেউ বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাইছে না। সৎ সহবত তো মুসলিম সমাজ থেকে একরকম নির্বাসনই নিয়েছে; কেউ ভাল কথা বললেও অন্য আরেকজন ভাবে - এর পিছনে নিশ্চয় কোন কুমতলব আছে!
মুসলিমরা আজ ঐক্যের বদলে বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমনসব ছোট ছোট দল উপদলে বিভক্ত হয়েছে যে, অতি সাধারণ একজনও এখন যে কোন সময় ইসলামের মূল বিষয় নিয়ে ফতোওয়া দিয়ে বসে থাকে; ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে এই জাতীয় ফিতনা। পিতা মাযহাব অনুসরণ করেন তো সন্তান বলে মাযহাব মানা যাবে না; বরং প্রশ্ন করে বসে - নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম কোন মাযহাবের ছিলেন? কোর'আন আর হাদিসের বাহিরের কিছু করা যাবে না; অথচ, বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে একজন মুসলিমের জীবনে ইজমা, কিয়াস এর কোন বিকল্প নেই। না জেনে না বুঝে একেকজন একেকভাবে মুখেমুখে ফতোওয়া দিয়ে যাচ্ছে; এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এটা শিরক, ওটা কুফর, তুই কাফের, তুই মুরতাদ, তোর কল্লা কতল ফরজ, আরো কত কি! এসব যে কত বড় গুনাহের কাজ, তা কি তারা একবাবও কেউ চিন্তা করে দেখেছে?
৩৬০ আউলিয়ার এই পুন্যভূমির মুসলিমদের ইমান ও আকিদা ছিল পৃথিবীতে অনন্য। আমরা যখন ছোট ছিলাম দেশে এতএতোসব ফিতনা ছিল না, এতএতো মসজিদ ছিল না; কিন্তু একজন মুসলিমের ইমান আকিদার ঘাটতি ছিল না। আমাদের বাড়ি থেকে মসজিদ মাদ্রাসা ছিল বেশ দূরে। তাও সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন আমরা দলবেধে মক্তবে কোর'আন শিখতে যেতাম। নামাজের সময় হলে বাড়িতেই একজন না একজন আজান দিতেন, উঠোনে বা বাংলাঘরে সবাই জামাতে শরীক হতাম। ফরজের পাশাপাশি ফজরে ২ রাকাত, জোহরে ৬ রাকাত, মাগরিবে ২ রাকাত, এশায় ২ রাকাত সুন্নতও বাধ্যতামূলক আমরা আদায় করতে শিখেছি; রমজানে উঠোনে মাদুর পেতে ২০ রাকাত তারাবী আদায় করতাম। আজকের মত মুসলিম সমাজে এতো বিশ্রিঙ্খলা তখন ছিল না; কথায় কথায় ফতোওয়া দেয়ার মতো এইসব তথাকথিত এতো আলেমও ছিল না। লোকজন যথেষ্ট ধার্মীক ছিলেন, অন্তরে আল্লাহ-র ভয় রেখে সবাই খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই, নেই কোন রক্ষাকর্তা; তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করা যাবে না; করববাসীর কবর জিয়ারত করতে হবে; ওদের জন্য ও দুনিয়ার সকলের জন্য দোওয়া করতে হবে; এইসব শিখেই আমরা বড় হয়েছি।
আজ যদি কেউ কবরে সেজদা করে, এই ব্যর্থতা তো আজকের আলেমদের; আ'মরুবিল মা'রুফ নাহি বিন মুন'কারের দায়িত্ব তাঁরা সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। নিশ্চয়, ওদের মাঝেরই কেউ না কেউ এই বদ আকিদার প্রবর্তক। কবরের স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করার ইতিহাসটা তো মাত্র আড়াইশ বছরের, ইবনে তাইমিয়া ফিতনা। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় তথাকথিত আলেমসমাজ এসবের সমর্থন করতে করতে এখন ইসলামের অনেক মূল ও মৌলিক আকিদাতেও হাত ডুকিয়ে দিয়েছে, এমন কি নামাজ কালামেও। মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেলে দেখা যায়, শুধুমাত্র ফরজ আদায় করে একদল বেড়িয়ে যাচ্ছে, সুন্নত আদায় করার নাকি কোন দরকার নেই! তারাবীহ নামাজ ৪ রাকাত ৮ রাকাত আদায় করলেই হয়; এর নাকি কোন বাধ্যবাদকতা নেই। শুক্রবারের জুম্মায় মসজিদে মুসুল্লির অভাব দেখি না, অথচ খুদবা শোনা বা আগের পরের সুন্নত আদায় করার তাদের কোন প্রয়োজন নেই; কোনভাবে দুই রাকাত ফরজ আদায় করেই দলে দলে সব মসজিদ থেকে বেড়িয়ে যায়। কে শিখিয়েছে ওদের এ'সব, এই আকিদাহ প্রবর্তক কারা?
আপনি নামাজ আদায় করেন কার জন্য? মাযহাব ওয়ালারা যদি এইসব সুন্নত ওয়াজিব সৃষ্টি করে থেকে থাকেন তো তাঁরা কার খুশির জন্য এসব করেছেন? আপনারা কি ভাবেন - তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ইমামদের চেয়েও আজকের তথাকথিত আলেমরা কোর'আন ও সুন্নাহ-র জ্ঞান কি বেশি রাখেন?
আজ আমি এইসব ফেতনাবাজদের মুখোশ উন্মোচনে ইসলামে ফিরক্কা সৃষ্টিকারী দু'এক জনের ইতিহাস তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। ধৈর্য ধরে পড়ে নিজ উদ্যোগে আরো বেশি জেনে নেবেন আশা করি; কারণ - ইমান আকিদা নষ্ট হলে রোজ হাশরের ময়দানে এইসব তথাকথিত আলেমরা কিন্তু আপনার হিসাব দেবে না, সেদিন কিন্তু ছাড়া পাবেন না।
দল মত নির্বিশেষে আমরা সবাই নিজকে মুসলিম দাবী করি এবং সবাই মুখে বলি - আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত - উম্মতে মুহাম্মদী; অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের উম্মত। কিন্তু বাস্তবতা কি? শ্রেষ্ঠত্বের কোন কাজটা করি বা করছি আমরা?
অবাধ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এসে আমরা এতোটাই জ্ঞানী সাজছি বা হয়ে গেছি যে, হাতের কাছে থাকা ডিজিটাল গুগোল সার্চ দিয়েই বলে দেই - এটা জায়েজ, ওটা না-জায়েজ। যার সামনে যেটা পরে সেটা নিয়েই আমরা বাড়াবাড়ির এক চরম পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হই; অথচ প্রকৃত সত্য জানার বুঝার বা উদঘাটনের ন্যুনতম যোগ্যতাও আমাদের নেই।
ফিকাহ-র ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা বলে একটা কথা আছে, আমরা তা কেউ জানতে চাই না; জানলেও সামাজিক প্রক্ষাপটে তা মানতে চাই না। ছোট থেকে জেনে আসছি - হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী চারটি সহিহ ফিকিহ মাযহাব। এখন একদল তথাকথিত আলেম বলছে - বাপ-দাদার পালন করা এইসব রীতিনীতি নাকি অনুসরণ করা যাবে না! এদেশের ওহাবী আকিদাহ-র তথাকথিত আলেমরা বর্তমান সমাজে ঝেঁকে বসেছে, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েও টানাটানি করে মুসলিমদের ইমান ও আকিদা নষ্ট করার উন্মত্ত নৃত্য শুরু করেছে তারা। আসেন সবাই জেনে নেই কোত্থেকে এই ফিতনার উৎপত্তি!
ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সন্ত্রাসী ও জঙ্গী দল হলো খারেজী সম্প্রদায়। এর উৎপত্তির কয়েক শতাব্দী পর সিরিয়ার অধিবাসী ইবনে তাইমিয়া আরেকটি চরমপন্থী দল সৃষ্টি করে। প্রথমদিকে তারা হাম্বলী মাযহাবের বলে পরিচয় দিতো। পরে তাদের ধর্মবিশ্বাস ও সন্ত্রাসের কারণে ইবনে তাইমিয়া ও তার অনুসারীদের মুসলিম শাসকরা ইসলাম বহির্ভুত সম্প্রদায় বা মুরতাদ বলে ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা লিখেছেন, "একদা দামেস্কের জামে মসজিদে ইবনে তাইমিয়া ঘোষণা করেছিল- আল্লাহ আসমান হতে জমীনে নামেন, ঠিক যেভাবে আমি নেমে যাচ্ছি বলে ইবনে তাইমিয়া মিম্বর থেকে নেমে পড়ে। (নাঊযুবিল্লাহ) আল্লাহ পাক মানবসুলভ আকৃতি বিশিষ্ট মতবাদের সে একজন দৃঢ় বিশ্বাসী হিসেবে কুখ্যাত।“
তার আরো কিছু বদ আকিদাহ জানুন -
"উমর ইবনুল খত্তাব (রা.) জীবনে বহু ভুল করেছেন; আলী (রা.) জীবনে তিনশো ভুল করেছিলেন।" (নাঊযুবিল্লাহ) – এধরনের অসংখ্য মন্তব্য করায় ইবনে তাইমিয়াকে কয়েক বার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কারাগারেই ২৭শে সেপ্টেম্বর ১২২৮ সালে সে মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুর পর তার ভ্রান্ত মতবাদ বিলীন হতে যাচ্ছিলো, কিন্তু সেই ভ্রান্ত মতবাদকে বিশ্বের মুসলিমদের কাছে নতুনভাবে উপস্হাপন করেন আরবের নজদ প্রদেশের আরেকজন; যার নাম মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নাজদী। তার প্রবর্তিত মতবাদকেই ওহাবী মতবাদ বলা হয়। এবং তার অনুসারীদের বলা হয় ওহাবী। বিভিন্ন দেশভেদে ওহাবীরা বিভিন্ন নামে পরিচিত; সৌদি আরব ও মিসরে সালাফি নামে, বাংলাদেশে ওহাবীরা নিজেদের আহলে হাদিস ও অন্যান্য নামে পরিচয় দেয়।
ইবনে তাইমিয়া স্বঘোষিত ফতোয়াতে বলে - রাত ও দিন পরস্পর লক্ষ লক্ষ ফেরেশতা যে প্রিয়নবীর রওজা শরীফে আগমন করছেন বলে মুসলমানদের মধ্যে যে প্রবাদবাক্য রয়েছে, তা একেবারে মিথ্যা কথা। আর যদি ফেরেশতা দৈনন্দিন রওজা পাকে অবতরণ করে থাকেন তা সত্য হলে তাঁরাও হারাম কাজে লিপ্ত হচ্ছে।
ইবনে তাইমিয়ার উক্ত ধর্ম কুৎসা সম্বলিত ফতোয়া ঘোষিত হওয়ার পর মিশর, শ্যাম ও দামেশকের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্তরে আঘাত লাগে। উক্ত কুফুরী ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে শরীয়ত সম্মত কি সাজা দিতে হবে সে সম্বন্ধে ওলামায়েকেরাম হতে ফতোয়া তলব করা হয়।
আল্লামা বোরহান বিন ফারকাহ ফজারী (রঃ) ও আল্লামা শিহাব বিন জাবহাল (রঃ) উভয় ধর্মীয় মুফতী কোর'আন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ৪০ পৃষ্ঠার একটি ফতোওয়া রচনা করেন। সে ফতোওয়াতে ইবনে তাইমিয়াকে কাফের ও ধর্মচ্যুত বলে ফতোওয়া প্রদান করা হয়। ফতোওয়াটি হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের কাজীদের সমীপে পেশ করা হয় এবং হানাফী মাযহাবের সরকারী কাজী বিন জারিরী (রঃ) ঘোষণা করেন যে, ইবনে তাইমিয়াকে বিনা শর্তে গ্রেফতার করে কতল করা হউক; কারণ ধর্ম কুৎসাকারী ধর্মচ্যুতেরই শামিল।
হানফী মাযহাবের কাজীর রায়কে প্রাধান্য দিয়ে তৎকালীন বিচারক মন্ডলী ইবনে তাইমিয়াকে শাবান মাসের ৭২৬ হিজরী সনে দামেশকের কিল্লাতে বন্দী করেন এবং ৭২৮ জিলকদ মাসের ২০ তারিখ বন্দী অবস্থায় সেখানে বড় দুরবস্থায় সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। - [সাফুসসাকিল আল্লামা কাওসারী]
ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমন কাহীনিতে উল্লেখ করেছেন "তাকিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া নামে দামেস্কে একজন হাম্বলী ধর্মশাস্ত্রবিদ ছিলো। তার অগাথ পান্ডিত্য ছিলো, কিন্তু আধপাগলা ধরনের মানুষ ছিলো সে। দামেস্কের লোকেরা তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতো। তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে মিম্বরে দাড়িয়ে সে ধর্ম সম্বন্ধে বক্তিতা দিতো। একবার তার কোন বক্তব্যের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রবিদরা একমত হতে পারলেন না। বিষয়টি সুলতানের গোচরীভূত করলে তিনি ইবনে তাইমিয়াকে কয়েক বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় সে কুরানের তাফসীর লেখে; চল্লিশ খন্ডে সমাপ্ত সেই তাফসীরের নাম রাখে 'সমুদ্র'। অতঃপর ইবনে তাইমিয়ার মাতা সুলতানের সঙ্গে দেখা করে তার মুক্তি কামনা করেন। ইবনে তাইমিয়া পুনরায় অনুরুপ অপরাধ না করা পর্যন্ত মুক্তই ছিলো। এক শুক্রবার তাইমিয়া যখন মিম্বর থেকে খুতবা পড়ে মুসল্লিদের শোনাচ্ছিল তখন আমি (ইবনে বতুতা) সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খুতবার মধ্যে সে বলে, "আমি যে ভাবে অবতরন করেছি ঠিক সেভাবে আল্লাহও আমাদের মাথার উপর আকাশে অবতরন করেন।" একথা বলেই সে একধাপ নিচে নেমে এলো। একজন মালেকি সম্পদায়ের শাস্ত্রজ্ঞ ব্যাক্তি তার প্রতিবাদ করলেন এবং তার কথায় ঘোর আপত্তি করলেন। উপস্থিত সাধারন শ্রোতারা গিয়ে তাকে যথেচ্ছভাবে প্রহার করতে লাগলো। প্রহারের সময় তার মাথার পাগরি পড়ে যায়। পাগরির তলায় লোকটির মাথায় ছিলো একটি রেশমি টুপি। রেশম ব্যাবহার এর জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গেলো হাম্বলিদের কাজীর কাছে। কাজী লোকটিকে কারাগারে বন্দি করে প্রহারের হুকুম দিলেন। এ ব্যবহারের প্রতিবাদ করলেন অপরারপর শাস্ত্রবিদগন। তারা বিষয়টি আমিরের কাছে গোচরীভূত করলেন। তিনি সমুদয় লিখে পাঠালেন আমিরের কাছে। অধিকন্ত তাইমিয়া বিভিন্ন সময় যে সব আপত্তি করেছে তারও একটি ফিরিস্তি সুলতানের নিকট দাখিল করলেন। তাইমিয়া অমরন সে দূর্গে বন্দি ছিল।"
ইবনে তাইমিয়ার ইন্তেকালের পরে তার মতবাদ প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নামের অন্য একজন আবির্ভূত হয়ে ইবনে তাইমিয়ার সেই ছাইয়ে ঢাকা আগুনকে আবার উন্মোচন করে। মূলতঃ ওহাবী মতবাদের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটায় এই মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব; আর তারই নাম অনুসারে সৃষ্টি হয় ওহাবী মতবাদ। আব্দুল ওহাব নজদীর পরিচয় নিম্নে দেওয়া হলঃ
প্রফেসর এ,এম, ফয়েজ আহমদ চৌধুরী সাহেবের বাংলা ও উর্দু আভিধানের ৩০০ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, “মোহাম্মদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারী দলকে ওয়াহাবী বলা হয়”। বাংলা ভাষায় ওয়াহাবী শব্দ ও ‘ওহাবি’ বানানে স্বীকৃত । তাই, বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা আভিধান ১৭৮ পৃষ্ঠায় ‘ওহাবি’ অর্থে লেখা আছে, “ধর্ম-সংস্কারক নজদবাসী মোহাম্মদ ইবন আবদুল ওয়াহহাবের অনুসারী বা শিষ্য”। জন্মঃ শায়খ মোহাম্মদ আবদুল ওহাব নজদী ১৭০৩ খৃস্টাব্দ, ১১১৫ হিজরীতে আল-আরবের নজদের (বর্তমান রিয়াদ) ওয়াইনা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে এবং ১২৮৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করে (ওনওয়ারুল মাজদ ফিতারী তারিখে নজদ ১ম খন্ড ৬ষ্ট পৃষ্ঠা রিয়াদে ছাপা)।
মুক্তি সংগ্রাম ঢাকা-বাংলা একাডেমী ৩১/০১/৮৬ইং ১৭ই মাঘ ১৩৯২ বাং দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত । ডকটর এ, আর. মল্লিক “ব্রিটিশ নীতি” গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কয়েক দশক ধরে যে ওহাবী আন্দোলন ভারত উপমহাদেশের বংগীয় এলাকা থেকে শুরু করে সুদুর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সমস্ত এলাকা ছড়িয়ে পড়েছিলো, এখনই আলোচনার সুবিধার্থে সেই ওহাবী আন্দোলনের গোড়ার কথা বলতে হয়। ওহাবী আন্দোলনের প্রবর্তক ছিল মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব। তার জন্মতারিখ সম্বন্ধে মতভেদ রয়েছে। তিনি ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপকভাবে অধ্যয়নের পর বিভিন্ন এলাকা পরিভ্রমণ কালে ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যাদান করেন এবং তীব্র ভাষায় শাসক কর্তৃপক্ষের সমালোচনায় মুখর হন। এ সময় আল-আরবের অধিকাংশ এলাকাই তুরস্কের সুলতানের অধীনে ছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবের এই সব বক্তব্য তুর্কী সুলতানের জন্য খুবই বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায় এবং অচিরেই তাকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই নয়, তুর্কী শাসক কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীকে সরকার বিরোধী অবস্থানের অভিযোগে সিরিয়ার দামেস্ক শহর থেকে বহিস্কার করে দেন।
সাহিত্যিক “'ওয়ালীউল্লাহ'-র মতে তিনি এই স্থান সেই স্থান পরিভ্রমণে বহুদিন অতিবাহিত করে অবশেষে দেরইয়ার সরদার মোহাম্মদ বিন সৌদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারই সাহায্যে তিনি বেদুঈনদের সমন্বয়ে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে প্রথম সুযোগে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এইরূপে অতি অল্প কালের মধ্যে মরু অঞ্চলে বিশেষ করে নজদ প্রদেশে আবদুল ওহাব নজদীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহাম্মদ বিন সৌদের সহিত তার এক ভগনিকে বিবাহ দিয়ে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব সমগ্র নজদের শাসন ক্ষমতা তার হাতে অর্পণ করে শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে নিজে সকল কর্তা হয়ে রইলেন।
বাগদাদের তুর্কী শাসনকর্তা নজদের মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবকে দমন করার লক্ষে ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বিরাট সেনাবাহিনীর দল প্রেরণ করেন । কিন্তু যুদ্ধে তুর্কীবাহিনী পরাজিত হলে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। ১৭৯১ সালে ওহাবীরা পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। কিন্তু সম্পূর্ণ সফল হতে পারে নি। ১৭৯৭ সালে তারা বাগদাদ আক্রমণ করে ইরাকের একটি এলাকা নজদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। প্রসংগতঃ উল্লেখ্য তুর্কী সুলতান এই ওহাবীদের কর্মকান্ডে এতোদূর বিরাগভাজন হয়েছিলেন যে, এদের হজ্জ পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এখানে আরো একটি ব্যাপার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবের অনুসারীরা সব সময়েই ইসলামের নামে নিজেদরকে মুবাল্লেগ মুজাহিদ হিসেবে পরিচয় দিতেন। অন্যদিকে গোপনে গোপনে নিজেদের ভ্রান্ত মাযহাব প্রচারে রত থাকতেন। ১৮০১ সালে আবার প্রায় লক্ষাধিক ওহাবী মুজাহিদ পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। কয়েক মাস ব্যাপী এই যুদ্ধে মক্কা নগরী ওহাবীদের দখলে আসে এবং সে সময়ে তুর্কী শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৮০৩ সাল নাগাদ ওহাবীরা পবিত্র মদীনা নগরীর উপর আক্রমণ পরিচালিত করে উহার উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে। সাহাবা, আওলিয়া ও ওলামা কেরামদের মাজার শরীফ ও সৌধ ভেঙ্গে দেয়। এমনকি প্রিয় নবীর রওজা পাকের একাংশও তাদের হাত হতে রক্ষা পায়নি । এদিকে পবিত্র মক্কা ও মদীনা নগরী দুটি হস্তচ্যুত হওয়ায় তুর্কী খলিফা খুবই রাগান্বিত ছিলেন। এছাড়া ওহাবীরা প্রিয় নবীর রওজা শরীফের অংশবিশেষ ভেঙ্গে দিয়েছে, এ কথাটা এবং অন্যান্য কয়েকটি অভিযোগ তুর্কীরা সমগ্র বিশ্বে বিশেষতঃ মুসলিম দেশগুলোতে রটিয়ে দিল। যার ফলে ১৮০৩ থেকে ১৮০৬ খৃষ্টাব্দের ভিতরে বহিরাগত হজ্জযাত্রীদের সংখ্যা খুব কমে গিয়েছিল। এই রকম এক পরিস্থিতিতে মিশরের শাসনকর্তা (খেদিব) মোহাম্মদ আলী পাশা তুরস্কের সুলতানের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ওহাবীদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্তাম্বুলের নিকটবর্তী এলাকায় সংঘটিত লড়াইয়ে ওহাবীগণ চরমভাবে পরাজিত হয়। ১৮১২ খৃষ্টাব্দে মিশরীয় বাহিনীর সেনাপতি “স্কটিশ টমাস কীর্থ” এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা দখল করে। ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে সেনাপতি কীর্থ মক্কা নগরীও অধিকার করে নেয়। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্য ওহাবীদের সামরিক শক্তি একেবারেই শূন্যের কোটায় এসে যায়। অতঃপর বাদবাকী ওহাবীরা ইসলামী মোবাল্লেগ নাম ধারণ করে ধীরে ধীরে গোপনে গোপনে ওহাবী মাযহাব পালন করতে থাকে; যা বিশেষভাবে প্রাধান্য পায় ভারতের দেওবন্দ নামক স্থানে।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা অফিসার মিস্টার হামফ্রে এককভাবে ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা নিযুক্ত ছিলেন তুরস্ক, ইরাক, ইরান ও অন্যান্য আরব দেশসমূহে; তার ডাকবাংলা ছিল ইরাকের অন্যতম শহর বসরার তরখানে। তার গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মের উপর আঘাত হেনে মুসলিম জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। হামফ্রের ডায়েরীতে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর ঈমান, আকীদা ও চরিত্রাবলীর কথা উল্লেখ রয়েছে। হামফ্রের উক্ত ডায়েরীটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীদের হস্তগত হয়। তখন জার্মান পত্রিকা “ইসপিগল” ডায়েরীটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। এতে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর ঈমান, আকীদা ও চরিত্র সম্বন্ধে সম্যকভাবে জানা যায়।
"হামফ্রে" ডায়েরীতে মিস্টার হামফ্রে বলেন - আমি যখন বসরার তরখানের গোয়েন্দাগিরীতে নিয়োজিত ছিলাম তখন একজন মুসলিম ধর্ম সংস্কারক লোকের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সেই ব্যক্তি তুর্কী, ফার্সী ও আরবী ভাষায় কথা বার্তা বলতে পারতেন। তিনি দ্বীনী তালেবে ইলেমের পোষাক পরিধান করে এদিক সেদিক বেড়াতেন। তিনি বড় উচ্চাভিলাসী উচ্চ মর্যাদাকাঙ্খি ব্যক্তি ছিলেন। আমি তার পরিচিতি চাইলে, তিনি অত্যন্ত অহংকারের সাথে বললেন, 'আমি মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী।' নজদী সাহেব তৎকালীন তুরস্কের ওসমানী সরকারের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা পোষণ করতেন। তার দৃষ্টিতে হানাফী, শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবের কোন মর্যাদা ছিল না।
নজদী সাহেবের বক্তব্য হলঃ আল্লাহর কোরআনে যা আছে তাই আমল যোগ্য। মিস্টার হামফ্রে বলেন, নজদী সাহেব প্রয়োজন হলে নিজ অভিমতের পক্ষে ইমাম ইবনে তায়মিয়ার মতামত প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন। আম্বিয়া, সাহাবা ও আওলীয়ায়ে কেরামগণ তার নিকট ছিল অতি তুচ্ছ। আমি ভেবে দেখলাম যে, নজদী সাহেবের মত স্বাধীনচেতা লোক আমার দরকার। এরূপ লোক দ্বারা ইসলামী সমাজে ফাটল ধরানো সহজ হবে। তাই একদিন আমি নজদী সাহেবকে তরখানের ডাক বাংলায় আমন্ত্রণ করলাম; নজদী সাহেবও আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
আমার আমন্ত্রণে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী তরখানের ডাক বাংলায় নির্দিষ্ট সময়েই উপস্থিত হন। যেদিন নজদী সাহেব ডাক বাংলায় উপস্থিত হন সেদিন ডাক বাংলার খাবার টেবিলে শিয়া তর্কবীদ শেখ জাওয়াদ কুসমী সাহেবও উপস্থিত হন। আমি উভয় ধর্ম সংস্কারককে খাবার টেবিলে খাবার দিলাম। খাবার মধ্যে দুজন সংস্কারক পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে তর্কে লিপ্ত হন। কারণ ওহাবী ও শিয়া মতবাদের মধ্যে মাযহাবী মতভেদ ছিল অনেক।
খাবার পর শেখ জাওয়াদ আমাকে গোপনে বললঃ এই নজদী সাহেব বৃটিশ সরকারের উদ্দেশ্যাবলীকে কার্যকরী করার জন্য উপযোগী হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাকে যেভাবেই হউক কাবু করতেই হবে। তাই শেখ জাওয়াদ ক্রমে ক্রমে নজদী নামের উচ্চাভিলাসী, আত্মপুজারীকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। এমনকি শেখ জাওয়াদ নজদী সাহেবকে ফাঁদে ফেলার জন্য তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করল। সামান্য কিছু দিনের মধ্যে উভয় ধর্ম সংস্কারকের মধ্যে অস্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
একদিন শেখ জাওয়াদ বলেন, আমি নজদী সাহেবের সঙ্গে কোরআন, হাদীস, নবী, সাহাবা ও আওলীয়ায়ে কেরামগণের সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য প্রস্তাব দিলাম। নজদী সাহেবও এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন ।
প্রথম দিনে মুতা বিবাহ নিয়ে শিয়াপন্থী শেখ জাওয়াদ সাহেব মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীকে জিজ্ঞেস করলেন - হে নজদী সাহেব, মহিলাদের সাথে মুতা তথা অস্থায়ী বিবাহ করা সম্পর্কে আপনার রায় কি? নজদী বললেন - মুতা বিবাহ হারাম এতে কোন সন্দেহ নেই।
শেখ জাওয়াদ সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করলেন - যদি মুতা বিবাহ হারাম হয়, তবে কোর'আনে উহাকে জায়েয ঘোষণা দেওয়া হলো কেন? যেমন সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'যদি তোমরা কোন মহিলার সঙ্গে মুতা বিবাহ করতে ইচ্ছুক হও, তবে তাদের মোহরানা আদায় করে দিও।'
মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী সাহেব পাল্টা উত্তর করেন - শেখ সাহেব, আল্লাহ-র কোর'আনের আসল অর্থ সকলের বুঝা বড় মুসকিল। কোরআনের আয়াত একেবারে নিজ স্থানে সঠিক আছে। কিন্তু ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, 'মুতা প্রিয় নবীর যুগে প্রচলিত ছিল; এখন আমি উহাকে হারাম বলে ঘোষণা দিলাম। আজ হতে যদি কেহ অস্থায়ী বিবাহে লিপ্ত হয়, আমি তার গর্দান উড়ায়ে দিব।'
শেখ জাওয়াদ এই উত্তর শ্রবণে অবাক হয়ে বললেন - হে ওহাবী সাহেব, আপনি কি ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে অনুসরণ করেন? অথচ আপনি ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে অধিক জ্ঞানী। ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর কি ক্ষমতা আছে যে, সে আল্লাহ ও রাসূলের বিধানকে নাড়াচাড়া করবে। আর আপনি অস্থায়ী বিবাহকে হারাম বলে ঘোষণা দিয়ে কোর'আনের সিদ্ধান্তের বিপরীত করছেন। (আস্তাগ ফিরুল্লাহ)
মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী আমতা আমতা করে বললেন, আজ হতে আমি মুতা বা অস্থায়ী বিবাহ বৈধ ঘোষণা দিলাম।
শেখ জাওয়াদ উক্ত উত্তর পাওয়ার পর ওহাবী সাহেবের যৌন উত্তেজনাকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। ওহাবী সাহেব যখন মুতা বিবাহ বৈধ ঘোষণা দিলেন তখনও তিনি অবিবাহিত ছিলেন। শেখ জাওয়াদ মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবকে জিজ্ঞাসা করলেন - আপনি কি মুতা বিবাহ করে নিজের জীবন আনন্দদায়ক করতে চান?
নজদী সাহেব মাথা নাড়া দিয়ে মুতা বিবাহের সম্মতি দিলেন। অতঃপর শেখ জাওয়াদ ওয়াদা দিলেন যে, আমি ইহার একটা ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ। তবে শেখ জাওয়াদের ভয় হল যে, ওহাবী সাহেব বসরার ছুন্নীদের ভয়ে ভীত হয়ে যায় নাকি। কারণ ছুন্নীরা মুতা বিবাহকে হারাম বলেন। শেখ জাওয়াদ মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবকে বললেন - ভাই নজদী, আমার ওয়াদা সঠিক পাবেন এবং আমার প্রোগ্রাম একেবারে গোপন থাকবে। এমনকি আপনি যে রমণীর সঙ্গে মুতা করবেন তার নিকটও আমি আপনার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবো না।
একথা বলার পর শেখ জাওয়াদ বলেন, আমি মুতার ব্যবস্থার জন্য নিদিষ্ট পাড়াতে চলে আসলাম। বসরায় ইংরেজ উপনিবেশ সরকারের পক্ষ হতে চরিত্র নষ্টের জন্য খৃষ্টান এক সুন্দরী রমণী নিয়োজিত ছিল। সে মহিলার নিকট আমি সবিস্তারে মুতার পরিকল্পনার কথা বললাম। সে মহিলা মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবের সঙ্গে মুতা করতে রাজীও হল। তখন আমি সে মহিলার তথাকথিত নাম রাখলাম সূফিয়া; আর আমি মহিলাটিকে বললাম, যথা সময়ে নির্ধারিত ব্যক্তিকে তোমার নিকট নিয়ে আসবো।
নির্দিষ্ট রাতে আমি মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী সাহেবকে সঙ্গে করে তথাকথিত সুফিয়ার নিকট পৌঁছে গেলাম। তিনি এক আশরফীর বিনিময়ে সুফিয়াকে মুতা বিবাহ করলেন। অতঃপর অবিবাহিত যুবকের স্বাধীন চিন্তাধারার নতুন স্বাদ পান করলো সুন্দরী সুফিয়া।
ইসলামের যতটা ক্ষতি করেছে বিধর্মীরা, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে করছে তথাকথিত এমনসব আলেমরা। মুসলিমের আভ্যন্তরীন কোন্দল সৃষ্টি করেছে এইসব ভন্ডরাই। অবশ্য, হুজুরপাক (সাঃ) সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগেই বলে গেছেন - বনী ইসরাঈলে ছিল ৭২ ফিরক্বা; এর মাঝে ১টি ছিল জান্নাতী, আর ৭১টি ছিল জাহান্নামী। আর উম্মতে মুহাম্মদী-র মাঝে হবে ৭৩ ফিরক্বা: এর মাঝে ১টি হবে জান্নাতী আর বাকী ৭২টি হবে জাহান্নামী।
بسم الله الرحمن الرحيم
عن عبد الله بن عمرو قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ليأتين على أمتي ما أتى على بني إسرائيل حذو النعل بالنعل حتى إن كان منهم من أتى أمه علانية لكان في أمتي من يصنع ذلك وإن بني إسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة وتفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة كلهم في النار إلا ملة واحدة قالوا ومن هي يا رسول الله قال ما أنا عليه وأصحابي (سنن الترمذى-كتاب الايمان، باب ما جاء في افتراق الأمة، رقم الحديث-2641
অর্থৎ - হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন - আমার উম্মত তা’ই করবে যা করেছে বনী ইসরাঈলের লোকেরা; এক জুতা অপর জুতার সমান হওয়ার মত। এমনকি যদি ওদের মাঝে কেউ মায়ের সাথে প্রকাশ্যে জিনা করে থাকে, তাহলে এই উম্মতের মাঝেও এরকম ব্যক্তি হবে যে একাজটি করবে। আর নিশ্চয় বনী ইসরাঈল ছিল ৭২ দলে বিভক্ত; আর আমার উম্মত হবে ৭৩ দলে বিভক্ত। এই সব দলই হবে জাহান্নামী একটি দল ছাড়া। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন-সেই দলটি কারা? নবী কারীম (সাঃ) বললেন-যারা আমার ও আমার সাহাবাদের মত ও পথ অনুসরণ করবে। - (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৪১, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস নং-৭৬৫৯, আল মু’জামুল আওসাত, হাদীস নং-৪৮৮৯, কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদীস নং-১০৬০)
মূলতঃ নামায কালাম রোযা হজ্জ সব মুসলিমই করবে, তবুও যে ৭২টি দল জাহান্নামে যাবে তাদের পার্থক্য শুধু ইমান, আক্বীদা ও আমলের। ইবলিস ৬ লক্ষ বছর ইবাদত করে, ফেরেশতাদের মুয়াল্লিম হয়েও সে জাহান্নামী হয়ে গেল শুধুমাত্র ঈমান না থাকার কারণে। যার জাররা পরিমাণ ইমান থাকবে, সে জান্নাতে যাবে। কিন্তু অন্তরে কুফরী রেখে হাজার নামায-কালাম পড়লেও কেউ কোনদিন জান্নাতে যেতে পারবে না। তাই আক্বীদা বিশুদ্ধ করা সকলের জন্যই ফরয। আর সেজন্যই বাতিল ফিরক্কা আক্বীদা সম্পর্কে জেনে তাদের কুফরী থেকে সাবধান থাকাও অতি জরুরী।
শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিন ও তাঁর হাবীব হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম-এর উপর ঈমান আনলেই প্রকৃত মু'মিন হওয়া যায় না। বরং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর প্রতিটি বিষয়েও বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করতে হয়। অতঃপর শরীয়তের নির্দেশ অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগী করতে হয়। কাদিয়ানীরা রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে রাসুল হিসেবে মানলেও তাঁকে খতামান নাবিয়্যীন হিসেবে না মানার কারণে তারা কাফির হয়ে গেছে। আশা করি, আক্বীদার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।
বর্তমানে বাতিল ফিরক্কাগুলো অনবরত আমাদের চারপাশে ঘুরছে; যারা মানুষের মাঝে বদ-কুফরী আক্বীদা ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেসব বাতিল ফিরক্কা ও ব্যক্তি বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের ঈমান আমলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, সেগুলোর কিছু হলো - খারেজী শিয়া, আহম্মদী বা কাদিয়ানী, ওহাবী, আহলে হাদিছ বা লামাজহাবী, সালাফি, জামাতী মওদূদী ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণ মুসলিমরা আক্বীদার গুরুত্ব না বোঝার কারণে এবং সৎ ও চৌকোষ আলেম-ওলামা, ওলী-আল্লাহর ছোহবতে না থাকার দরুন বদ-আক্বীদা পোষণ করে অনেকে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছে। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং সাধারণের ঈমান-আমল হেফাযত করার উদ্দেশ্যে আজ এই এতো দীর্ঘ বর্ণনা করলাম। কোন মুসলিমের ন্যুনতম উপকার হলেও আমার এই প্রচেষ্টা সার্থক মনে করবো।
মানবতার ধর্ম ইসলাম, মহানুভবতার ধর্ম ইসলাম; সততা, সহিষ্ণুতা, সমব্যথীতা একজন মুসলিমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি ও একজন মুসলিমের ইমান আকিদা কি হওয়া উচিৎ - সে দিকে দৃষ্টি রেখে আপনার বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়ে একটু চেষ্টা করলে নিজেই ৭২ ফিরক্কা মিলাতে পারবেন।
হে আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিন! আমাদের সবাইকে এইসব বাতিল ফিরক্কা চেনার তৌফিক দান করুন এবং ওদের গোমরাহী থেকে আমাদের হেফাজত করুন।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২ মে, ২০১৭.