সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০

ধর্ষণ!


ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেই ধর্ষক সব চুপসে যাবে, আমি মোটেও তা মনে করি না। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান মন্ত্রিসভায় নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে জেনে খুশি হয়েছি, কিন্তু দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি বা বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার যে বাজে অবস্থা তা চিন্তা করে শংকিতও হচ্ছি; মোটেও ভরসা পাচ্ছি না। এ থেকে বিচারব্যবস্থা কি আদপে বেরুতে পারবে? বিচার প্রক্রিয়ার গ্যারাকলে পড়ে কোন ধর্ষিতা আবার বারংবার ধর্ষিত হবে না তো? যে গাছের গোড়ায় পচন, সে গাছের আগায় পানি দিয়ে কি লাভ হবে? 

যে জাতির বেশিরভাগ মানুষের বোধ-বুদ্ধি বলতে গেলে লোপ পেয়েছে, সে জাতির সামনে এসব কাগুজে আইন পাশের খবরের কোন মাহাত্ম্য আছে কি? তাছাড়া বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আমাদের দেশে চলমান বিদ্যমান, সমাজব্যবস্থাকে যা প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, সেখানে শুধুমাত্র আইন পাশ করে কোন লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না; বরং আইনের প্রয়োগের জন্য কঠিন  আইন করা উচিত, করতে হবে। ভাবতেও কষ্ট লাগে— লাইন না থাকলে এখনো এদেশে আইনের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না বা পাওয়া যায় না! আইনের প্রয়োগ অপপ্রয়োগ সব যেন দূর্বলের জন্য! হাই/হ্যালো  বা অনৈতিক  অর্থনৈতিক সুবিধার মাঝে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সবকিছু। আমরা তো এমন ছিলাম না, কেন এমন হলাম? অন্যের দোষ খুব বেশি চোখে পড়ে আমাদের,  নিজের দোষ মোটেও চোখে পড়ে না। পুরো সমাজব্যবস্থায়ই ধস নেমেছে, দেশের বিচারব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে সে তো অনেক আগেই, অথবা শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র আইন সংশোধন করে বা সাজা বাড়িয়ে কি লাভ?   

যে মানুষের মগজে পচন ধরে সে মানুষকে বাঁচানো কঠিন, আর যে সমাজের রন্ধ্রে পচন ধরে সে জাতির কপালে অন্ধকার অমানিশা। সমাজের প্রতিটি স্তর যেভাবে নষ্ট হয়েছে শুধুমাত্র আইন করে কি ধ্বংস ঠেকানো বা রোধ করা সম্ভব?  কাগুজে  আইন যতই করা হউক না কেন, তা কার্যকরী না হলে তাতে জাতির কোনই কল্যাণ হবে না, এবং যতদিন না মানুষের বিবেক জাগ্রত হবে ততদিন কিছুতেই কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া আইন যখন নিজস্ব গতি হারিয়ে প্রভাবশালীদের হাই/হ্যালো বা বিত্তবানদের অর্থের বৃত্তে আবদ্ধ  হয়ে পড়েছে, সে সমাজে সাধারণ জনগণ কি আশা করতে পারে বা পারবে? তা তাদের কোন কল্যাণেই আসবে না। সমাজের প্রতিটি সাধারণ মানুষ আজ জিম্মি, অসহায়। হাতেগোনা কিছু অমানুষের কাছে আমরা প্রায় সবায় জিম্মি, সেইসব কিছু দুষ্কৃতিকারীর কাছেই আমরা যেন সব কিছু তুলে দিয়ে বসে ঝিমাচ্ছি। আর তারা নির্ভয়ে ও নির্ভাবনায় তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। 

স্পর্শকাতর কিছু ঘটনায় হয়তো আমরা সোস্যাল মিডিয়ায় কখনো চিল্লাচিল্লি করি, করছি  লিখছি কেউ কেউ! সেই প্রতিবাদ আন্দোলন বা আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতে যদিওবা কোন অপরাধীর বিরুদ্ধে সরকার সক্রিয় হয়, কিছু করে, এক সময় দেখা যায় আইনের মারপ্যাঁচে ফলাফল শূন্য; রায় বিলম্বিত হওয়ার কারণে ভিকটিম নিশ্চুপ হয়ে যায়, আর সেই সুযোগ নেয় ধর্ষক। তাছাড়াও আরও কিছু বাজে সংস্কৃতি এর পেছনে কাজ করে— একশ্রেণির লোকের আইনি ব্যবসাকে চাঙ্গা করার প্রক্রিয়ায় বিচারকার্য দীর্ঘ হতে থাকে, সরকারেরও চেষ্টা থাকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরানোর; জন্ম হয় নতুন ধর্ষকের! এভাবেই জন্ম নিচ্ছে নতুন ধর্ষক। 

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া, প্রচারমাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে যে ছকে বেঁধে রাখা হয়েছে সেই ছকের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ ঢুকে গেছে অদ্ভুত সব অমানবিকতার চর্চা এবং তা আমরাই করছি। প্রতিটি ছক চলছে এখন অদ্ভুত এক পুঁজিবাদী আর বস্তুবাদী কায়দায়। আর এ'সকল সকল মিডিয়ায়ই নারী হলো আনন্দ-বিনোদনের এক মোহনীয় পণ্যবস্তু! ফলে নারীরা কখনো  নিজেকে উচ্চতর সত্তা ভাবতেও পারছে না। সবখানে এমনভাবে নারীকে চিত্রায়িত করা হচ্ছে— যেন নারীর কাজই হলো নিজেকে রূপসজ্জায় সজ্জিত রাখা বা করা! আর পুরুষ হবে সেই সাজসজ্জার ভোক্তা! এভাবে মিডিয়া আজ নারী ও পুরুষ উভয়কে মোহাচ্ছন্নতার জালে আবদ্ধ করে ফেলেছে এবং রাখছে। আর এ ধরনের মিডিয়াকেই দেয়া হচ্ছে অপার স্বাধীনতা। বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজিবাদী বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো চাঙ্গা রাখতে এরূপ নিম্নমানের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের মদদও যোগানো হচ্ছে।

অন্যদিকে প্রায় সবার হাতে আজ চলে এসেছে স্মার্টফোন। যে তিনবেলা খাবার জোগাড় করতে পারে না তার হাতেও আছে একটি স্মার্টফোন। এই স্মার্টফোনের মধ্যে কি রক্ষিত আছে তা আমরা কেউ ভাবি না! রক্ষিত আছে নেশাদ্রব্যের মতো অদ্ভুত সব বিনোদনসামগ্রী। এসব বিনোদন সামগ্রীই প্রতিটি মুহূর্তে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রত্যেককে ইন্দ্রিয় লালসায় উন্মত্ত করে তুলছে। একটি স্মার্টফোন যত সহজে একজন মানুষকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে, এমনটি আর কোন যন্ত্র করতে পারে কিনা আমার সন্দেহ। ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সব দুয়ার আজ বন্ধ হওয়ার পথে বা হয়ে গেছে। মাদকের ব্যাপারে আইনি বাধা থাকলেও স্মার্টফোনের ব্যাপারে কোন আইনি বাধাই নেই। অথচ স্মার্টফোন যে ভয়ংকর মাদকতা ছড়াচ্ছে, তা ভাবারও অতীত। এর পরিণতি কত ভয়ানক ও ভয়াবহ তা হয়তো অনেকে কল্পনাও আনতে পারে না। শুধুমাত্র স্মার্টফোনের মেসেঞ্জারে প্রতিদিন যে পরিমাণ ইভ টিজিং হয়, তা কেউ হিসাব রেখেছে কি? ভুক্তভোগীমাত্রই তা জানেন ও বোঝেন। আমার মনে হয় শুধুমাত্র ফেসবুক মেসেঞ্জারে যে ইভ টিজিং প্রতিক্ষণে হয়, তা-ই অন্য সব মাধ্যমকে হার মানায়!

বেশিরভাগ ধর্মীয় বয়ানেও প্রাজ্ঞতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে; বক্তারা এমন সব বক্তব্য করে বা দেয় যেখানে ক্ষণে ক্ষণে থাকে অতি উত্তেজক কথাবার্তা। কেউ কেউ আবার এমনসব  বাচনভঙ্গি করে যা নারীর বিরুদ্ধে পুরুষকে উস্কে দেয়। যারা এসব করছে, তাদের মধ্যে সূক্ষ্মদর্শী বিশ্লেষণের বড়ই অভাব দেখা যায়; সস্তা জনপ্রিয়তা ও ভোগ তাদের একমাত্র কাম্য। এসব বয়ানে নারীদের যেভাবে হিজাবের ব্যাপারে উচ্চ সতর্ক হতে বলা হয়, সেভাবে পুরুষদের লক্ষ্য করে কখনো তাদেরকে তেমন একটা বলতে দেখি না। তাছাড়া নারীর বেপর্দাকে যেভাবে ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হয়, সেভাবে পুরুষের বেপর্দাকে দায়ী করা হয় না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী যেহেতু পুরুষ, সেক্ষেত্রে কী করে পুরুষরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কীভাবে নারী ও পুরুষের নৈতিকতার চর্চা করতে হয়, এসব বিষয় নিয়ে তারা খুব একটা ভাবে না, বা এসব বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞানও নেই বলে মনে হয়।

তাছাড়া গ্লোবালাইজেশনের ছোঁয়ায় আধুনিক শিক্ষার বর্তমান অবস্থা কি? উত্তেজনাই যে শিক্ষার প্রথম পাঠ, নৈতিকতা গঠনের পরিমাপক। যেখানে  বহুবিধ সম্পর্ক, পরকীয়া আর ব্যভিচারকে বলতে গেলে সামাজিক বৈধতা দেয়া হয়! হটাৎ এক দিনে তো এসব ঘটছে না বা এমন অবস্থা হয়নি? মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষের মানসিক বিকাশ বিষয়ে একটি বৈপ্লবিক তত্ত্ব দিয়েছিলেন, আজকের দুনিয়ার মানুষ সেই তত্ত্ব অনুসরণ করেই চলছে। এ থেকেই এসব; এবং সমাজের এমনটা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এই তত্ত্বে মানুষের মানসিক বিকাশকে কাম তথা যৌনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। 

ফ্রয়েডের মতে— মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সর্বমোট পাঁচটি যৌন স্তরের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হয়। এর যে কোনও একটিতে সমস্যা- বিশেষ করে অতৃপ্তি ঘটে গেলে মানুষের ব্যক্তিত্ব অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। শিশুকাল থেকে যে পাঁচটি মানসিক যৌন স্তরের মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হয় সেগুলো হচ্ছে— মৌখিক অবস্থা (oral stage), পায়ু অবস্থা (anal stage), শিশ্ন অবস্থা (phallic stage),সুপ্তযৌন অবস্থা (latency stage), এবং উপস্থঃ অবস্থা (genital stage)।

ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের যৌন বাসনাগুলো যদি ভালভাবে পূর্ণ না হয়, তবে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সেজন্য তিনি মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশের স্তরগুলোকে মনোযৌন বিকাশ নামকরণ করেছিলেন। ফ্রয়েড মনোযৌন বিকাশ তত্ত্ব দ্বারা প্রমাণ করেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মতো শিশুদেরও যৌন অনুভূতি থাকে। শৈশবকালে নিজ দেহের যৌন-সংবেদী অঞ্চলগুলির সুখদায়ক অনুভূতি শিশুকে যৌন-তৃপ্তি দেয়। শৈশব যৌনতাকে ফ্রয়েড আত্ম-রতি (Auto-Erotism) বলে অভিহিত করেছিলেন।

বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় আজ আমরা সকলেই কমবেশি ফ্রয়েডীয় চিন্তা-চেতনার দাস হয়ে ধীরে ধীরে অনুগামীও হয়ে পড়েছি। আধুনিক শিক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির অবাধ প্রসারে ফ্রয়েডীয় ধ্যান-ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ফ্রয়েডীয় লিবিডো ধারণাকেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বের সকল পুঁজিবাদী মিডিয়া। ফলে সকল মাধ্যমেই কামুকতার চর্চাকে আজ আত্মনিয়ন্ত্রণের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর তাতে অভ্যস্ত করে তুলছে আমাদের সবাইকে। 

যৌবনের ধর্ম হলো এক অদ্ভুত অবদমন বা মানসিক অস্থিরতা অনুভব। আমারা কি পারছি বা কতটা পেরেছি আমাদের  সমাজে ফ্রয়েডীয় চিন্তার পরিপূর্ণ বিস্তার ঘটাতে? কত পার্সেন্ট বাবা-মা তার সন্তানের সাথে যৌবনের ধর্ম নিয়ে খোলামেলা আলাপ করতে পারে? বা কত পার্সেন্ট পোলাপানই-বা সুযোগ পায় কার্যকরী ফ্র‍য়েডীয় মতবাদ শিখার বা প্র‍য়োগের? তাই তো স্মার্টফোন মিডিয়ায় ডুবে থাকা নগ্নতার নিষিদ্ধ আকর্ষণে না-জানা না-চেনা নেশায় উন্মত্ত  হয়ে অনেকেই ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে উদ্ভুদ্ধ হয়ে উঠে; তাই তো এর এতো বিস্তার এত প্রসার; যা আজ মহামারী রূপ নিয়েছে। আমি বলি কি— সমস্যাটা আসলে ধর্ষণের মধ্যে নয়, সমস্যাটা সমাজের; অনাঙ্ক্ষিতভাবে ফ্রয়েডীয় কালচারের প্রচার-প্রসার ও অপরিপক্ক অভ্যস্ততার। তাই, গোড়ায় হাত না দিয়ে আগা পরিস্কার করে কোন লাভ হবে না, চিন্তা করতে হবে মূল সমস্যার, নয়তো সমস্যা আরও প্রকট হবে এবং ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

সময় এসেছে নতুনভাবে চিন্তা করার— নিজেকে পাল্টাবার, তবেই পাল্টাবে সমাজ; পাল্টাবে দেশ ও জাতি। তখন আর এদেশে কোন নারী ধর্ষিত হবে না, ধর্ষকের জন্য নতুন আইনও পাশ করতে হবে না।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
১২ অক্টোবর, ২০২০.